শিক্ষাক্ষেত্রে রোল মডেল বাংলাদেশ
মো. মুরাদ হোসেন
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নানা অভিযোগ-অনুযোগ রয়েছে। কিন্তু গত এক দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু অর্জন বিশ্বের বহু দেশের কাছে অনুকরণীয়। আমরা শিক্ষায় সহস্রাব্দির উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হয়েছি। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা আর শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক, ইউনেস্কো, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামসহ আন্তর্জাতিক দাতা ও গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতিকে অন্যদের জন্য উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করছে।
দেশে ৪০টি সরকারি ও ৯৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৩১ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। একসময় বছরে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভারতে উচ্চশিক্ষা নিতে যেত, এখন যায় না বললেই চলে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ৬৩০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। শিক্ষার্থীদের এই পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে বিপুলসংখ্যক তরুণ শিক্ষা অর্জন করছে। তাদের জন্য প্রয়োজন বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ। এজন্য পুঁথিগত অর্থাৎ সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার উন্নয়নের বড় কারণ কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন। সিঙ্গাপুরে এ শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ ও মালয়েশিয়ায় ৪০ শতাংশ। যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়ায় কারিগরি শিক্ষার হার ১৭ থেকে ৫৮ শতাংশ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ছিল ১ শতাংশেরও কম। কারিগরি শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার হার ২০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। শিক্ষকদের কারিগরি জ্ঞানে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
পিছিয়ে পড়া মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করেছে বর্তমান সরকার। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে মাদরাসা অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ শিক্ষায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। সাধারণ বিষয়ের মতো তথ্য ও প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান বিষয় চালু করা হয়েছে। কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মাদরাসার উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এনে বিশ্বমানের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দেশে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওলামা একরাম, পীর-মাশায়েখ, এদেশের ইসলামি চিন্তাবিদ, মাদরাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ৮০ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন।
তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে এই বিষয়ে পারদর্শী তরুণ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে বাধ্যতামূলকভাবে তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়কে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কয়েক বছর আগেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার সম্পর্কে জানত না। এখন প্রায় প্রতিটি স্কুলে রয়েছে এ যন্ত্র। মাধ্যমিক শিক্ষার ২৩ হাজার ৩৩১টি প্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। ডিজিটাল কনটেন্ট, ভিডিও, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পুরো বিশ্ব এখন শিক্ষার্থীদের হাতের কাছে।
বাংলাদেশের নারী শিক্ষার অগ্রগতির কথা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, ‘মালালা ইউসুফ জাই নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর পাকিস্তানে নারী শিক্ষার পথে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এবং উগ্রবাদী ইসলামিক মতাদর্শের ভূমিকা আবারো বিতর্কের কেন্দ্রে। কিন্তু প্রায় একই ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে।’
বিশ্বব্যাংক তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করে তুলে ধরেছে সরকারের উদ্যোগ ও অর্জনের নানা দিক। বিশ্বব্যাংক বলছে, ‘বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তুমুল গতিতে দুস্তর পথ অতিক্রম করেছে এবং শিক্ষায় অভিগম্যতা ও সমতা অর্জনে অনেকদূর এগিয়েছে। মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ হওয়ায় বাংলাদেশ টেকসই ফল বয়ে নিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে লাখ লাখ শিশুর বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা, নারী সাক্ষরতা বৃদ্ধি, মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক অপর এক প্রতিবেদনে দেশের শিক্ষার বহুমুখী অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরে বলছে, প্রাথমিক স্কুলে মোট ভর্তির হারে শতভাগসহ অন্য শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ৬২ শতাংশ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪৪ এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে।
বর্তমানে দেশে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। সরকার একসঙ্গে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলকে সরকারিকরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। যেসব উপজেলায় সরকারি স্কুল ও কলেজ নেই; সেসব উপজেলায় স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণ করছে সরকার।
দীর্ঘদিন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, কলেজে ভর্তি ও ক্লাস শুরুর নির্ধারিত সময় ছিল না। পরীক্ষার ফল বের হতে তিন-চার মাস সময় লাগত। এভাবে মাস ছয়েক সময় নষ্ট হয়ে যেত। এখন সব কিছুতেই শৃঙ্খলা এসেছে। কয়েক বছর ধরে সময়মতো পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস শুরু হয় ১ জানুয়ারি; উচ্চ মাধ্যমিকে শুরু হয় ১ জুলাই।
এরপরেও দেশের শিক্ষা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষার কাক্সিক্ষত মান নিশ্চিত করা যায়নি। শহর ও গ্রামে এখনো শিক্ষা মানের বড় ধরনের ব্যবধান রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। মেধাবী শিক্ষকদের এই পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর সুপারিশ রয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিতে। এছাড়া শিক্ষকদের নৈতিক শিক্ষা জরুরি। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা-এই মন্ত্র ধারণ করছেন না তারা। কোচিং বাণিজ্যসহ প্রশ্ন ফাঁসের মতো গুরুতর অপরাধে শিক্ষকরা জড়িয়ে পড়ছেন। এত কিছুর পরও শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়েছে। তাই শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মান অর্জনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনই।
লেখক: যুগ্ম-সম্পাদক, প্লাটফর্ম-একটি সমাজসেবা সংগঠন
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment