আইসিইউ
সৈয়দ বোরহান কবীর: ২০ ফেব্রুয়ারি, বিকাল ৪টা। একটা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে করে আমার বাবাকে নিয়ে এলাম স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জরুরি বিভাগে ঘণ্টা খানেকের দৌড়ঝাঁপের পর তাকে নেওয়া হলো চারতলার আইসিইউতে ১১ নম্বর বেডে। আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে চারতলায় পৌঁছলাম। আইসিইউতে সাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। মাইক নিয়ে বসে আছেন একজন গার্ড। বন্ধ দরজা। আর করিডরে জনা পঞ্চাশেক মানুষের উদ্বিগ্ন মুখ। কেউ কাঁদছে, কেউ সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে, কেউ অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আমরা তিন ভাই দাঁড়ালাম। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলাম। এ যেন এক রোলার কোস্টারে চড়ার এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। অবশেষে ২১ মার্চ বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় স্কয়ার হাসপাতাল থেকে ফোন এলো। পড়িমড়ি করে হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম নিথর দেহে পড়ে আছেন আমার বাবা। আমার বাবা চলে গেলেন, কিন্তু আমরা জানলাম না, কেন তিনি মারা গেলেন। কী অসুখ হয়েছিল তার।
ঘটনার শুরু গত বছরের ডিসেম্বরে। হাসি-খুশি মানুষটি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলেন। খেতে পারছিলেন না। আমার বাবা কাজ খুব ভালোবাসতেন। আমরাও তার কাজে বাধা দিতাম না। পেশায় আইনজীবী এই মানুষটি কাজ করলেই ভালো থাকেন—এমন একটা বোধ আমরা লালন করে আসছিলাম। সেই কর্মচঞ্চল, সদাহাস্য মানুষটিই হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। সন্তান হিসেবে আমাদের তো উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা। একে একে আটজন ডাক্তার দেখালাম। স্কয়ার হাসপাতালে পাঁচজন আর এ্যাপোলোতে তিনজন। কেউই বলতে পারলেন না—কেন তিনি খেতে পারছেন না। এর মধ্যে বাবার চোখের সমস্যা দেখা দিল। তাকে নিলাম ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হকের কাছে। তিনিই প্রথম বললেন, ‘তোমার আব্বাকে ভালো লাগছে না। একটা বোর্ড করে দেখাও।’ স্কয়ার হাসপাতালে কিডনির ডাক্তার মোসাদ্দেক আহমেদকে আগেই দেখিয়েছিলাম। বাবার কিডনির কিছু সমস্যাও ধরা পড়েছিল। তাই আবার তার শরণাপন্ন হলাম। স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করালাম। এখানে একে একে সব ডাক্তার দেখালাম। ওষুধের পর ওষুধ দিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু বাবার ক্ষুধামন্দা বেড়েই চলল। ১১ দিনের মাথায় ডাক্তার বললেন, ‘এটা বয়সজনিত। বাসায় নিন, যা খেতে চান খাওয়ান। একটু জোর করে খাওয়ান।’ ডাক্তারের কথায় আমাদের উৎসাহ বেড়ে গেল। আমরা এটা সেটা বেশি বেশি করে খাওয়ানোর কসরৎ শুরু করলাম। মাত্র দুই দিনের মধ্যে বাবার ডায়রিয়া হয়ে গেল। আবার স্কয়ার হাসপাতাল। এবারও দেখলেন ‘বিখ্যাত’ সব ডাক্তার। গ্যাস্ট্রো-লিভার, নিউরো কিছুই বাদ গেল না। বাবার ডায়রিয়া সারল কিন্তু ক্ষুধামন্দা বাড়তেই থাকল। ডা. মোসাদ্দেক বললেন, ‘নল দিয়ে খাবার দেব।’ আমাদের তিন ভাইয়ের কোনো কিছুতেই না নেই। নল দিয়ে ১৪ দিন খাবার দেওয়া হলো। কিন্তু তারপরও বাবার জীবন স্বাভাবিকের কাছাকাছি এলো না। একদিন ডাক্তার জানালেন, এভাবে তো আর বেশি দিন রাখা যায় না, বাসায় নিয়ে যান। ১৪ দিনে কী পরীক্ষা হলো না বাবার; এমআরআই থেকে আলট্রাসনোগ্রাম, রক্ত, পেশাব, পায়খানা সব। বাবার অসুখ কী? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না চিকিৎসকরা। অগ্যতা ডাক্তারের পরামর্শে বাবাকে আবার বাসায় নিয়ে গেলাম। দ্বিতীয় দফায় হাসপাতাল যাপনের সময় বাবাকে দেখতে এসেছিলেন ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি নামি ডাক্তার। মূলত সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী স্যারই ডা. আবদুল্লাহকে স্কয়ারে নিয়ে আসার অসাধ্য কাজটি সাধ্য করেছিলেন। তাকে দেখে আমার বাবা মুগ্ধ। আমার ছোটভাই পেশায় চিকিৎসক। সে তো প্রায় অজ্ঞান। তিনি কিছু কথাবার্তা বললেন, কিন্তু সবার মন জয় করে নিলেন। দ্বিতীয় দফায় বাবা বাড়িতে থাকল মাত্র তিন দিন। তৃতীয় দিন থেকে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সকালে আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ডা. এ বি এম আবদুল্লাহর অধীনে সেন্ট্রাল হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করাব। ডা. আবদুল্লাহকে ফোন করলাম। তিনি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। বললেন ‘সরাসরি সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসেন, আমি আসছি।’ আমাদের পৌঁছানোর ১০ মিনিটের মধ্যে তিনি এলেন। বাবাকে দেখে বললেন ‘নিউমোনিয়া হয়েছে। বেশি দিন হাসপাতালে থাকলে প্রবীণদের এটা হয়।’ আমি তো অবাক। হাসপাতালে মানুষ যায় রোগ সারাতে অথচ হাসপাতালে গিয়ে কিনা রোগ বাঁধল! অবাক হওয়ার সময় তখন খুবই কম। কারণ শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা মানুষটিকে দ্রুত অক্সিজেন দেওয়া হলো। ডা. আবদুল্লাহ তাকে খাবারের জন্য আবার নাকে নল লাগানোর নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন। আমাদের দেশে ডা. এ বি এম আবদুল্লাহর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক আছে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো জুনিয়র ডাক্তার, নার্স নেই। নল লাগানোর সময় দেখা গেল তাদের আনাড়িপনার চরম অবস্থা। নলের খাবার চলে গেল ফুসফুসে। দ্রুত বাবার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকল। বিকালে ডা. আবদুল্লাহ নির্দেশ দিলেন দ্রুত যেন বাবাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকালে বাবাকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হলো। সেন্ট্রাল হাসপাতাল ডা. এম আর খানের মতো কয়েকজন খ্যাতিমান চিকিৎসক করেছেন। কিন্তু এই হাসপাতালটাই যেন মুমূর্ষু রোগীদের এক মরণ ফাঁদ। আইসিইউ থেকে খানিকক্ষণ পরপর বলা হয় পানি লাগবে, টিস্যু লাগবে, ওষুধ লাগবে। তাহলে আর আইসিইউ কেন?
যাক ১৯ ফেব্রুয়ারি বাবার অবস্থা আরও খারাপ হলো। রাতে আমাদের জানানো হলো বাবার রক্ত লাগবে। অফিসে মাহাবুবকে ফোন করতেই আমার দুই সহকর্মী সেন্ট্রাল হাসপাতালে হাজির। রাত তখন ১১টা। এ সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাল, তাদের কোনো ব্লাড ব্যাংক নেই। একটু দূরে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের পাশে একটা ব্লাড ব্যাংকের ঠিকানা দিলেন। পাঠক চিন্তা করুন, ঢাকার বুকে গর্বিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে একটি বেসরকারি হাসপাতাল। যার আইসিইউ আছে কিন্তু কোনো ব্লাড ব্যাংক নেই। গ্রিন রোডে যে ব্লাড ব্যাংকে আমরা গেলাম, সেটি খুঁজে পাওয়া যেন এক আবিষ্কার। যেখানে আমার এক সহকর্মী রক্ত দিল। রক্ত এক কাগজের ঠোঙ্গায় মুড়িয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে এলাম। ভোর রাতে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলল, আপনার বাবার ডায়ালাইসিস লাগবে। কিন্তু আমাদের আইসিইউতে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা নেই। আমি চেয়ারে বসেছিলাম, এ কথা শুনে পড়ে গেলাম চেয়ার থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ এলেন। তার সঙ্গে ছোটখাটো বৈঠক হলো। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সেন্ট্রাল থেকে স্কয়ার হাসপাতালে নেব। কিন্তু মুমূর্ষু এই মানুষটিকে স্কয়ারে নেব কীভাবে। হাসপাতালের লোকজন রেডিমেড কাগজ ধরিয়ে দিল। তাতে ক্রিটি কেয়ার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের নাম এবং ফোন নাম্বার। হাসপাতালের প্রক্রিয়া শেষ হতেই লাগল দুই ঘণ্টা। এরপর অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলো। সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে স্কয়ারে যাব। তারা চাইল সাত হাজার টাকা। ব্যবসারও একটা নীতি-নৈতিকতা থাকে। কিন্তু এবার বুঝলাম, স্বাস্থ্য ব্যবসায় নীতি-নৈতিকতাই পরিত্যাজ্য। যাই হোক, কোনো মতে বাবাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিলাম। জরুরি বিভাগ থেকে বাবাকে নেওয়া হলো আইসিইউ বেড ১১তে। স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউর প্রধান ডা. রায়হান রব্বানী। আমার পূর্ব পরিচিত। এ জন্য ভরসা পেলাম। কিডনির ডা. মোসাদ্দেক আহমেদের সঙ্গে আমাদের আগে থেকেই পরিচয়। আমার মায়ের চিকিৎসক তিনি। আমরা আশার চূড়ায় উঠলাম। সন্ধ্যায় আমাদের আবেগীমনকে শান্ত করতে এগিয়ে এলেন ডা. মোসাদ্দেক। বললেন ‘আল্লাহকে ডাকুন’। ব্যস, আইসিইউর সামনের করিডর আমরা মসজিদ বানিয়ে ফেললাম। পরদিন ডা. রায়হান বললেন, অবস্থা একটু উন্নতি হচ্ছে। আমরা আজই একটা ডায়ালাইসিস দেব। ব্যস পরপর দুই দিন ডায়ালাইসিসের পর চিকিৎসকরা কিছু ডাটা বলা শুরু করলেন, টোটাল কাউন্ট কমেছে, এখন অক্সিজেনের জন্য কোনো সাপোর্ট লাগছে না। প্রেসার নরমাল ইত্যাদি। এসব মেডিকেল তথ্যউপাত্ত আমাদের উত্তেজিত করত, আনন্দিত করত, কাঁদাত। কিন্তু বাবা নীরব, নিথর। শুধু তার চোখ কথা বলত। চোখে যেন বাঁধভাঙা কান্না। তিনি কী জানি বলতে চাইছেন। দ্বিতীয় দিনই ফোন এলো স্কয়ার হাসপাতাল অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে। আপনার ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা ডিউ হয়েছে। প্রথম দিন চমকে গিয়েছিলাম। হঠাৎ চোখ অন্ধকার হয়ে গেল। পরে সামলে নিলাম। যা কিছু আছে সব দিয়ে হলেও বাবাকে সুস্থ করার শপথ নিলাম। দিনে এক লাখ টাকা প্রায় লাগে আইসিইউতে। তারপরও মুখ বুঝে বাবার রোগমুক্তি কামনা করি। আমার অসুস্থ মা বিকালে আসেন হুইল চেয়ারে। হাতে তসবি। বাবার নির্বাক চেহারা দেখে হাউ মাউ করে কাঁদেন। পাঁচ দিন পর আইসিইউ প্রধান ডা. রায়হান বললেন, বাবার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তার ইনফেকশন কমেছে। দুই দিন পর তাকে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে নেওয়া হবে। আমরা আনন্দে একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করলাম। পরদিন বিকালে আমাদের হতাশ করে রায়হান জানালেন, আবার বাবার ইনফেকশন হয়েছে। বেশ অবলীলায় বললেন ‘আইসিইউ হলো ইনফেকশনের ঘাঁটি।’ আবার শুরু হলো প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। একদিন কার্ডিওলজির ডা. তৌহিদের সঙ্গে দেখা। ডা. তৌহিদ বাণিজ্যমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের মেয়ের জামাই। ভালো ডাক্তার, তার চেয়েও ভালো মানুষ। তিনি আমাকে প্রথম ‘বেড শো’র সম্পর্কে সতর্ক করলেন। বেশি দিন একটা মানুষ শুয়ে থাকলে, তাকে নড়ানো-চড়ানো না হলে তার শরীরে ঘা হয়। এরকম হলে তাকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে যায়। আমি বিষয়টা নিয়ে ডা. রায়হান এবং ডা. মোসাদ্দেকের সঙ্গে কথা বললাম। তারা বিষয়টা উড়িয়ে দিলেন। বললেন, নার্স আছে, ২৪ ঘণ্টা এটেন্ডেন্ট আছে। কাজেই বেড-শোর হওয়ার কারণ নেই। এর মধ্যে দেখলাম ডা. মোসাদ্দেক আর ডা. রায়হানের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই। ডা. রায়হান বলেন, রক্ত দিতে হবে। মোসাদ্দেক বলেন অপেক্ষা করি।
দ্বিতীয় দফা ইনফেকশনে বাবার রক্তের প্লাটিলেট কমে যেতে লাগল। আমাদের বলা হলো রক্তদাতা লাগবে। আমরা রক্তদাতা জোগাড় করলাম। প্লাটিলেট টানা হলো। কিন্তু ওই প্লাটিলেট বাবার শরীরে গেল না। অথচ স্কয়ার হাসপাতাল বিল ঠিকই নিল। বাবার চোখ খুলে তাকানোও ১৪ দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে গেল। এরপর শুরু হলো চিকিৎসকদের লুকোচুরি খেলা, তথ্য গোপন করার কসরত। আমার স্ত্রী রোজ বিকালে বাবাকে দেখতে যায়। একদিন সেই আবিষ্কার করল বাবার কোমড়ে দগদগে ঘা। চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করলে তথ্য লুকানোর চেষ্টা। পাঁচ তারকা হাসপাতালে বাবাকে আনলাম সুস্থ করতে অথচ হাসপাতাল তাকে টাকা বানানোর মেশিন বানাল। এক সময় আমরা ধন্ধে পড়লাম তিনি কি বেঁচে আছেন, নাকি তাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে?
২১ দিনের মাথায় বাবার আবার ডায়ালাইসিস দেওয়ার কথা বললেন আইসিইউর প্রধান ডা. রায়হান। আমাকে বললেন, ‘ডা. মোসাদ্দেককে বলুন।’ সকাল-দুপুর-বিকাল রাত ডা. মোসাদ্দেকের দেখা নেই। অথচ প্রতিদিন তার নামে ১২০০ টাকা বিল হয়। রাতে তাকে পেলাম। তিনি আমাদের দেখে ক্ষেপে উঠলেন। যেন আমরা পথের ভিখারি। বিনাপয়সায় চিকিৎসা করতে এসেছি। ওই সময় আমি অনেক কিছুই করতে পারতাম। কিন্তু কিছু করিনি, মৃত্যু পথযাত্রী বাবার দিকে তাকিয়ে। আমাদের উদ্দেশ্যে চতুষ্পদ প্রাণীর মতো কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে ডা. মোসাদ্দেক চলে গেলেন। বাবাকে দেখলেনও না। রাত ১১টায় একজন জুনিয়র ডাক্তার বাবার ক্যাথাডার করলেন, তারপর ডায়ালাইসিস হলো। পরদিন সকালে হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি শুনেই বললেন, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। শুধু দেখলাম বাবার চিকিৎসক বদল হলো। একজন মুমূর্ষু রোগীকে কি মাঝপথে এভাবে চিকিৎসক বদলে দেওয়া যায়? কিংবা একজন চিকিৎসক কি মাঝপথে সরে যেতে পারেন?
বাবা দ্রুত খারাপ হতে লাগল। দ্রুত তার ঘা ছড়িয়ে পড়ল কানে, হাতে। ২১ মার্চ রাতে ডা. রায়হান ফোন করে বললেন হাসপাতালে আসুন। নিথর প্রাণহীন মানুষটাকে আমরা দেখলাম। বাবার শেষ শয্যা হবে রংপুরের পীরগঞ্জে। আমি একদিন পরপর বিল পরিশোধ করেছি। কাজেই ধারণা করলাম গতকালই যখন বিল দিয়েছি, এখন খুব বেশি বিল হবে না। আমি বললাম, দ্রুত আপনারা কাগজপত্র তৈরি করুন। আমাকে অবাক করে দিয়ে, আইসিইউ থেকে বলা হলো, ‘আগে আপনারা বিল পরিশোধ করুন। তার আগে আমরা কিছুই করতে পারব না।’ হতবাক হয়েও আমি অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্টে গেলাম। সেখানে বলা হলো অপেক্ষা করতে হবে। আমার চোখের সামনে এই স্কয়ার হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরীর চেহারাটা ভেসে উঠল। এই হাসপাতাল উদ্বোধন করার সময় তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘ব্যবসা করার জন্য আমি এই হাসপাতাল করিনি। মানুষের সেবা করার জন্য এই হাসপাতাল করেছি।’ আজ শুধু আমার নয়, প্রতিদিন স্কয়ারে এরকম ঘটনা ঘটে। মৃত্যুদেহ আটকে রেখে টাকা আদায় করা হয়। শুধু স্কয়ার কেন সব বেসরকারি হাসপাতালেই এটা স্বাভাবিক চিত্র। সে কথা অন্য সময় আলোচনা করা যাবে। বাবার বিল পরিশোধ করে আবেগ মথিত হৃদয়ে প্রশ্ন এলো ‘আমার বাবার অসুখ কী ছিল?’
প্রিয় পাঠক, এই ঘটনাটি আমার ব্যক্তিগত। কিন্তু আসলে কি এটা ব্যক্তিগত? আসলে কি এই ঘটনা শুধুই আমার? বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের একটি প্রাত্যহিক দৃশ্য এটি। আর বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের কর্ণধাররা অনেক প্রভাবশালী। আমি তো তাও ঘটনাটা লিখছি। অধিকাংশ মানুষ এটা মুখ বুঝে সহ্য করেন।
বাবার মৃত্যুর পর আমি ভাবছিলাম, বাবাকে কি চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়াটাই উচিত ছিল। আমি সব সময়ই দেশে চিকিৎসার পক্ষে। কিন্তু রোগী যখন হয় টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মেশিন, তখন আমার মতো দুর্ভাগা ছাড়া কে দেশের চিকিৎসায় আস্থা রাখবেন? মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে হয়। কিন্তু সন্তান হিসেবে মনের ভিতর সেই কাঁটা-টা বেঁধেই রইল- বিদেশে গেলে হয়তো বাবা বাঁচতেন। অনেক তো হলো। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি এখন একটু সেবামুখী, মানবিক হতে পারে না? আমার মতো প্রতিদিন এরকম অসংখ্য সন্তান, বোন, স্ত্রী, বাবা-মা চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রহসনে আর্তনাদ করছে। সে খবর কে নেবে? উন্নয়নের মহাসড়কে থাকা দেশটির স্বাস্থ্য খাতই যেন এখন আইসিইউতে মুমূর্ষু।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, বাংলা ইনসাইডার।
ই-মেইল : poriprekkhit@yahoo.com
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment