আত্মহত্যার মিছিল
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: সেদিন আমি একটা ই-মেইল পেয়েছি। সেখানে ছোট একটা লাইন লেখা, “স্যার, আত্মহত্যার মিছিলে আরও একটি নাম যুক্ত হলো…”, এই লাইনটির নিচে আত্মহত্যার খবরটির একটা লিংক। আমার বুকটা ধ্ক করে উঠলো। কারণ, আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেছি কে আত্মহত্যা করেছে, কেন আত্মহত্যা করেছে। যে ই-মেইলটি পাঠিয়েছে সে আমাকে আগেই সতর্ক করে বলেছিল আমি আরও আত্মহত্যার খবর পাবো। শিক্ষার মান উন্নয়ন করার জন্য যে সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে এরা সেসব কলেজের ছাত্রছাত্রী। এই দেশের ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়ার পরও আমরা কেমন করে আমাদের দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছি? আমাদের ভেতর কোনও অপরাধবোধ নেই?
এই সাতটি কলেজের একটি কলেজ থেকে একজন ছাত্র কিছুদিন আগে আমাকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিল। সে আমাকে লিখেছে, তাদের শিক্ষার মান উন্নয়ন করার এই পরিকল্পনা তার মতো আড়াই লাখ শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাদের সঙ্গে যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তারা চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে অথচ তারা এখন পর্যন্ত প্রথম বর্ষ শেষ করতে পারেনি। শুধু তা-ই না, পরীক্ষা দিতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করেছে, চার ঘণ্টার পরীক্ষার জন্য তাদের তিন ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে (বিষয়টা মনে হয় আরও জটিল, আশি নম্বরের পরীক্ষার জন্য কোনও কোনও পরীক্ষা হয়েছে তিন ঘণ্টায়, কোনও কোনোটা সাড়ে তিন ঘণ্টায় এবং কোনও কোনোটা চার ঘণ্টায়। এটি সেই ছাত্রের অভিযোগ)।
ছাত্রটির অভিযোগের তালিকা আরও দীর্ঘ। তার মতে, সমস্যাগুলো হচ্ছে তীব্র সেশনজট, ফলাফল প্রকাশ হতে বিলম্ব, সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন, পরীক্ষার সময় কমানো, গণহারে ফেল, ফলাফলে ভুল এবং সেই ভুল সংশোধনের নামে হয়রানি, ফলাফল পুনঃসংশোধনের পর একেবারে একশভাগ ফলাফল আগের মতো রেখে দেওয়া ইত্যাদি। ছাত্রটির চিঠির লাইনে লাইনে হতাশা, তারচেয়ে জুনিয়র ছেলেমেয়েরা পাস করে বিসিএস দিচ্ছে অথচ সে নিশ্চিত যে পরীক্ষায় পাসই করতে পারবে না। যে পরীক্ষায় শতকরা নব্বই জন ফেল করছে সেই পরীক্ষায় সে কেমন করে পাস করবে? পরিচিত মানুষজন যখন তার লেখাপড়ার খোঁজ নেয়, সে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারে না। তার অভিযোগগুলো যে সত্যি সেটা প্রমাণ করার জন্য সে আমাকে কিছু কাগজপত্র পাঠিয়ে তাদের জন্য কিছু একটা করার জন্য অনুরোধ করেছে।
চিঠির শেষে সে লিখেছে—এর মাঝে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও করবে।
তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে। জুলাই মাসের ১৯ তারিখ বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের মিতু নামের একজন হাসিখুশি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবরটি পড়ার পর থেকে আমি এক ধরনের তীব্র অপরাধবোধে ভুগছি। লেখাপড়া করতে এসে ছাত্রছাত্রীরা আত্মহত্যা করে—এটি কেমন করে সম্ভব?
যে ছাত্রটি দীর্ঘ একটি চিঠি পাঠিয়েছিল সে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। সাহায্য করার মতো আমি কেউ নই, কিন্তু ডুবন্ত মানুষ খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে। আমি সেই খড়কুটো, তাই আমার পক্ষে যেটা করা সম্ভব সেটা করেছি, দেশের সংবাদপত্রের কাছে অনুরোধ করেছি সাত কলেজের অধিভুক্তির বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রয়োজন হলে কোনও ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করতে। সংবাদপত্রগুলো নিজেদের উদ্যোগেই কিংবা কেউ কেউ আমার অনুরোধে বিষয়টা নিয়ে নানা ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এখন আমি জানি আমার কাছে লেখা সেই ছাত্রের অভিযোগগুলো মিথ্যা নয়। সত্যি সত্যি তাদের জীবন নিয়ে এক ধরনের নির্মম পরিহাস করা হচ্ছে।
২.
আমাদের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ছাত্রছাত্রী পড়ে তার থেকে অনেক বেশি ছাত্রছাত্রী পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অসংখ্য কলেজে। যদি তাদের শিক্ষার মান যথেষ্ট উন্নত না হয়ে থেকে এবং সেটা উন্নত করার জন্য তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার প্রয়োজন হয়ে থাকে তাহলে অন্য কলেজগুলো কী দোষ করলো? তাদের শিক্ষার মান কী উন্নয়ন করার কোনও প্রয়োজন নেই? (পত্রপত্রিকায় যে রিপোর্ট বের হয়েছে সেখানে অবশ্য শিক্ষার মান উন্নয়নের কথা লেখা নেই, সেখানে বলা হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের ‘বিরোধ’ এর আসল কারণ। আমি অবশ্য অনেক চিন্তা করেও দুই জন ভাইস চ্যান্সেলরের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব কীভাবে এতবড় একটা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের কারণ হতে পারে কিছুতেই ভেবে পাইনি। তাই আমি ধরে নিচ্ছি শিক্ষার মান উন্নয়নই এর মূল কারণ এবং হয়তো পর্যায়ক্রমে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থানীয় কলেজের দায়িত্ব দেওয়ার মতো কোনও একটা পরিকল্পনা আছে! সেটি ভালো হবে না খারাপ হবে আমি মোটেই সেই বিতর্কে যাচ্ছি না)।
তবে আমরা মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত করার এই পরিকল্পনাটি কাজ করেনি। কেন করেনি সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করার ফলে তাদের বেশ কিছু বাড়তি কাজ করতে হয়,পরীক্ষা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়। এটি বিশাল দায়িত্ব! প্রশ্নপত্র মডারেশন করতে হয়, প্রশ্নপত্র মডারেশনের পর তার রূপ পুরোপুরি পাল্টে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। শতকরা দশভাগ ছাত্রছাত্রীর খাতা দেখতে হয়। আড়াই লাখ ছাত্রছাত্রীর দশভাগ প্রায় পঁচিশ হাজার ছাত্রছাত্রী,আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দুটি বিশ্ববিদ্যালয়! সোজা হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দুই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর খাতা দেখতে হয়। ভাইবায় বহির্সদস্য হিসেবে যেতে হয়, সব ছাত্রের জন্য এক মিনিট করে দেওয়া হলেও কত সময় দিতে হবে কেউ হিসাব করেছে? এছাড়াও পরীক্ষার ফল প্রকাশের বিশাল দায়িত্ব রয়েছে,নিশ্চয়ই সাত কলেজের শিক্ষকেরা সেখানে সাহায্য করেন কিন্তু দায়িত্বটুকু তো থেকেই যায়। কাজেই প্রশ্নপত্র কঠিন হয়ে যাচ্ছে,খাতা দেখতে দেরি হয়ে যাচ্ছে,ফল প্রকাশিত হচ্ছে না,ভুলভ্রান্তি হচ্ছে,সেগুলো ঠিক করা যাচ্ছে না। এবং অধিভুক্ত সাত কলেজের সব শিক্ষার্থীর জীবন হারাম হয়ে যাচ্ছে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ছাত্রছাত্রীরাও এই অধিভুক্তি বাতিল করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছে। ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ। প্রশাসনিক ভবনে তালা। আমি দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম কখন ছাত্রলীগের ছেলেরা মাঠে নামে। এখন তারাও নেমে পড়েছে। নিজেদের সঙ্গে নিজেদের সংঘাত শুরু হয়েছে,কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সংঘাত এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। সোজা কথায়, পরিস্থিতি যতটুকু জটিল হওয়া সম্ভব ততটুকু হয়ে গেছে। এখন ভবিষ্যতে সেটি কোনদিকে মোড় নেবে কেউ অনুমান করতে পারছেন না।
আমি যখন পিএইচডি করি তখন আমার সুপারভাইজার একদিন কয়েকজন গবেষকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। গবেষণার একটি বিশেষ ব্যাপার নিয়ে তারা একটা ভিন্নধর্মী কাজ করতে চান। আমার সুপারভাইজার ছিলেন খুবই চাঁছাছোলা মানুষ,তিনি অন্য গবেষকদের বললেন, “তোমরা এই ঘোড়াটাকে নিয়ে টানাটানি করতে চাও করো—আমি আপত্তি করবো না। কিন্তু ঘোড়া যদি মরে যায় তাহলে অতি দ্রুত এই ঘোড়াকে কবর দেওয়ার সাহসটুকু যেন থাকে।” তার কথাটি আমার খুব পছন্দ হয়েছিল এবং আমার নিজের জীবনে এটা মনে রেখেছি। যেকোনও ব্যাপারে নতুন কিছু চেষ্টা করার মাঝে কোন দোষ নেই,কিন্তু সেই নতুন কিছু যদি কাজ না করে তাহলে সেটাকে অতি দ্রুত “কবর” দেওয়ার সাহস থাকতে হয়। আমি মনে করি এই সাত কলেজের অধিভুক্তির বিষয়টি কাজ করেনি,তাই এখন যত দ্রুত সম্ভব এ ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এটার নিষ্পত্তি করে ফেলা উচিত। তবে আমাদের দেশে সেই কালচারটি এখনও গড়ে ওঠেনি। মৃত ঘোড়াকে কবর দেওয়া দূরে থাকুক, ঘোড়াটি যে মারা গেছে আমরা সেটাও স্বীকার করতে রাজি হই না। বাড়তি পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে পিএসসি এবং জেএসসি এই দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য একটু অহেতুক বিড়ম্বনা সেটি সবাই মেনে নেওয়ার পরও এই পরীক্ষা দুটি বাতিল করা হচ্ছে না! কাজেই সাতটি কলেজের বিষয়টা যেভাবে ঝুলে আছে সেভাবেই যদি দিনের পর দিন ঝুলে থাকে আমি একটুও অবাক হবো না। আমাদের নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে থাকতে হবে আবার না কোনও একদিন জানতে পারি আবার আরও কোনও ছাত্র বা ছাত্রী হতাশায় আত্মহত্যা করে ফেলেছে। একজন মানুষের জীবন কতো বড় একটি ব্যাপার! সেটি শুধু যে সেই মানুষটির জীবন তা নয়,তার সঙ্গে আরও কতো আপনজনের স্নেহ মমতা ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে,সেটি যখন এভাবে আমাদের অবহেলার কারণে হারিয়ে যায় আমরা সেটা কেমন করে মেনে নিই?
৩.
বেশ কয়েক বছর আগে শাবিপ্রবির আমাদের বিভাগটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় কারিগরি সাহায্য করেছিল। তখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো নিয়ে আমার একটা ধারণা হয়েছিল। তখন আমি প্রথমবার এই কলেজগুলোর গুরুত্বটা অনুভব করেছিলাম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর মোট ছাত্রসংখ্যা বিশ লাখ। কাজেই আমাদের যদি দেশের শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হয় তাহলে সবার আগে কোথায় দৃষ্টি দিতে হবে? অবশ্যই এই বিশাল ছাত্রসংখ্যার দিকে। আমরা যদি তাদের লেখাপড়ার মান একটুখানিও বাড়াতে পারি তাহলে তার প্রভাব হয় অনেক বড়,এটা হচ্ছে সহজ গাণিতিক হিসাব।
আমাদের দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ব্যর্থতা আমাদের—আমরা তাদের জন্য গবেষণার ক্ষেত্র গড়ে তুলতে পারিনি,কাজের পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি, তাদের উপযুক্ত অর্থ,বিত্ত,সম্পদ কিংবা নিরাপত্তা দিতে পারিনি,তাদের সন্তানদের সত্যিকার লেখাপড়ার ব্যবস্থাও করে দিতে পারিনি। আমার ধারণা, যদি কোনও ধরনের জরিপ নেওয়া হয় তাহলে আমরা দেখবো আমাদের এই দেশের মূল চালিকাশক্তির একটি বড় অংশ এই বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসেনি, এসেছে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কলেজগুলো থেকে।
আমরা তাহলে আমাদের কৃতজ্ঞতাটি কাদের জানাবো? আমরা কী সেটি করছি? তাহলে কেন আত্মহত্যা করে তাদের জীবনের অবসান করতে হচ্ছে?
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment