আদি অন্তে ঢাকা
এম মামুন হোসেন: ঢাকা নামটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। ঢাকাকে কতোটুকু জানি? ঢাকাকে কতোটুকু চিনি? ঢাকা হয়তো ইস্তাম্বুল, এথেন্স, বাগদাদ, রোম, লাহোর কিংবা দিল্লির মতো প্রাচীন নয়। কিন্তু ঢাকা মধ্যযুগের প্রাচ্যের সমৃদ্ধ নগরের একটি। সপ্তদশ শতকের প্রথম দশক থেকে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলার রাজধানী। সে হিসেবে প্রায় ৪০০ বছর আগে ঢাকায় রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল। তবে ভ্রান্তি বশত ঢাকার বয়স ৪০০ বছর বলে অনেকে ধরে নিয়েছে। সহস্র বছর আগেই এই জনপদে বসতি ছিল। চুড়িহাট্টা মসজিদ প্রাঙ্গণে মাটির নিচ থেকে আবিষ্কৃত মূর্তি, মহাখালী থেকে আবিষ্কৃত মূর্তি, খড়্গ-যুগীয় গুপ্ত অনুকৃত স্বর্নমুদ্রা প্রমাণ করে মুসলিম বিজয়ের অনেক আগে থেকেই ঢাকায় জনবসতি ছিল।
এখানে একটি শক্ত যুক্তি প্রমাণ হচ্ছেÑ ইসলাম খাঁ কোনো বিরাণভূমিতে রাজধানী স্থাপন করেননি। ‘ঢাকা’ নামের এই জনপদ মোগল রাজধানীর আগে থেকেই এখানে ছিল। সেই শহরে ইসলাম খান আসার আগেই একটি দুর্গও ছিল, সেই তথ্য ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথান ‘বাহারিস্তান-ই গায়বি’তে উল্লেখ করেছেন। মোগল, সুলতানি, সেন যুগ এবং এর কয়েকশ বছর আগে খড়্গ যুগে ঢাকায় জনবসতি থাকার সুষ্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। অবশ্য ঢাকার জৌলুশের প্রকৃত সূচনাকাল মোগলদের হাত ধরে। বঙ্গবঙ্গ (১৯০৫-১৯১১) সময়কালে পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হিসেবে ঢাকায় অনেক নতুন দালান উঠেছিল। সড়কও হয়েছিল। ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ক্রীড়া, খাদ্য, সমাজ ব্যবস্থার এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে মোগল আমল।
হাজারো অলিগলির রহস্যময় নগরী ঢাকা। আর সেই অলিগলির আড়ালে লুকিয়ে আছে বিচিত্র জীবন আর জীবনের জটিলতার কাহিনী। নানা কথা, উপকথা, কিংবদন্তি রয়েছে এ ঢাকা শহরের। প্রাচীন ঢাকার বহু কিংবদন্তি আজ আধুনিক ঢাকার বর্ণাঢ্য নির্মাণের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছে সেই জীর্ণ দেয়ালের স্মৃতি। তবে সুবেদার ইসলাম খা যখন ঢাকার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন তখন ঢাকা ছিল ছোট একটি গঞ্জ। চারশ বছর আগে মোগল শাসনকর্তা ইসলাম খা নতুন রাজধানীর স্থান নির্বাচনের জন্য বর্তমান ইসলামপুর এলাকায় বজরা থেকে নামেন। তখন তিনি দেখতে পান যে, সেখানে হিন্দুরা ঢাকঢোল বাজিয়ে পূজা-অর্চনা করছে। ঢাকের শব্দে ইসলাম খা অবাক হন। তিনি বাদকদের খুব জোরে ঢাকঢোল বাজাবার নির্দেশ দেন এবং তিন দিকে তিনজনকে পাঠান। একদিকের সীমানা থাকলো নদী। যে তিনজন তিন দিকে গেল তাদেরকে যেখানে গিয়ে আর ঢাকের শব্দ শোনা যাবে না, সেখানে তাদের সীমান্ত পতাকা স্থাপন করতে বলা হলো। পতাকা স্থাপনের পর ইসলাম খার নির্দেশে এসব স্থানে সীমান্ত স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল। এভাবেই মোগলদের হাত ধরে ঢাকার নগরপত্তন।
এর দুইশ বছর পর নবাব স্যার সলিমুল্লাহ যখন সরদার প্রথার প্রবর্তন ঘটান তখন ঢাকা শহরের পরিধি ছিল খুবই ছোট। পূর্ব-পশ্চিমে বড়জোর তিন মাইল। পশ্চিম দিকে এনায়েতগঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে ধোলাইখাল। অন্যদিকে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উত্তরে এক অথবা বড়জোর দেড় মাইল পর্যন্ত ছিল নাগরিক জনবসতি। তারপরও যে সব এলাকা ছিল যেমন তেজগাও, শিবপুর (পরে মিরপুর) এগুলো ছিল নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এলাকা। অথচ আড়াইশ’ বছর আগে ঢাকা ছিল একটি মহানগরী। সুবেদার শায়েস্তা খার আমলে উত্তরে টঙ্গী থেকে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত ৪৭-৪৮ বর্গমাইলব্যাপী এ মহানগরীতে জনবসতি ছিল ১৬ লাখ। অথচ সে সময় ইওরোপের বৃহত্তম নগরী লন্ডনের জনসংখ্যা ছিল মাত্র নয় লাখ।
আজকের আধুনিক মেগা সিটি ঢাকার পুরনো শহরের অলিগলিতে খুঁজে পাওয়া যায় স্মৃতি-বিস্মৃতির অনেক উপাদান। ঢাকার পরতে পরতে আছে নানা উপাখ্যান। কালের আবর্তনে ঢাকার আয়তন বাড়লেও বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহরের পরিচিতি আজো রয়ে গেছে। ঢাকার অলিগলির নামকরণ নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক জনশ্রুতি, আবার কোনো কোনোটি সম্পর্কে রয়েছে সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য। নামের সঙ্গে অনেক এলাকার এখন আর কোনো মিল নেই।
ঢাকার আদি বাসিন্দারা মূলত এখনো ঢাকাইয়া কুট্টি নামে পরিচিত। মোগল আমলে ঢাকাবাসীর মধ্যে মোগল শাহীর অধীনে চাকরি করতেন। জমিদার কিংবা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজেও জড়িত ছিলেন। তারা নিজেদের উচু স্তরের লোক ভেবে যথেষ্ট গর্ব অনুভব করতেন। সেসময় সমাজের অন্য পেশাজীবীদের অনেককেই ঘৃণার চোখে দেখা হতো। তখনো যন্ত্রের কোনো প্রচলন হয়নি। মানুষকে নিজেদের চাহিদার সব রকম উপকরণ হাতেই তৈরি করতে হতো। এসব পেশাজীবীর অনেকেই ধান কুটতো, যব কুটতো, ডাল কুটতো, সুরকি কুটতো, ইট কুটতো অর্থাৎ যে কোনো ধরনের কুটার কাজ যারা করতেন তারা ছিলেন খুবই দরিদ্র। একদিকে তারা গরিব, অন্যদিকে তারা কুটার কাজ করতেন আর যারা খাদ্যশস্য কুটে পরিষ্কার করতেন তাদের কুটিয়াল বলা হতো। তবে লোকমুখে ‘কুট্টি’ বলেই সম্বোধন করা হতো। এ পেশাই পরে পদবিতে পরিণত হয়। এ কুট্টি শব্দের প্রচলন ঢাকায় এভাবেই হয়ে পড়েছিল। সেইসব পেশাজীবী তাদের পেশা পরিবর্তন করে অন্যান্য পেশা গ্রহণ করলেও তাদের পদবির অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। লালবাগ, কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর থানার বাড্ডানগর, নবাবগঞ্জ, সিদ্দিকবাজার, পোস্তা, রহমতগঞ্জ, ডালপট্টি, চকবাজার, ছোটকাটরা, বড়কাটরা, ইমামগঞ্জ, জুম্মন ব্যাপারী লেন, কসাইটুলী, বংশাল, সাত রওজা, আগা সাদেক রোড, আলু বাজার, জিন্দাবাজার, বাকতাসা লেন, নয়াবাজার, কলতা বাজার, মুরগিটোলা, মহাজনপুর লেন, মালিটোলা, করাতিটোলা এসব মহল্লা ঢাকাইয়া অধ্যুষিত এলাকা। এখানেই ঢাকাইয়া কুট্টিদের বসবাস ছিল এবং এখনো এ এলাকাগুলোতে তারা বেশি বসবাস করে। তখনকার ঢাকার বনেদি পরিবারের প্রধান ব্যবসা ছিল চামড়ার ব্যবসা। হাজারীবাগ নবাবগঞ্জ, লালবাগের পোস্তায় এখনো চামড়ার ব্যবসা রয়েছে। কিছুসংখ্যক ঢাকাইয়া ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে আসামে অভিগমন করেন। চকবাজারের জাহাজ মার্কা ব্লিডিং মার্কেটটি ছিল ঢাকার একমাত্র পাইকারি মার্কেট। হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, লালবাগের পোস্তায় এখনো রাজমিস্ত্রি, ওস্তাগিরি, কোচোয়ান, ঠিকাদারি ও কিছুসংখ্যক হুক্কার ব্যবসা করতেন। ঢাকার কিছু দরিদ্র কুট্টিরা জিঞ্জিরায়ও বসবাস করতেন। তাদের ব্যবসা ছিল হুক্কা, টিন ও কাঠের ব্যবসা। এখনো জিঞ্জিরায় হুক্কাপট্টি নামে এলাকা রয়েছে। চকবাজার থেকে পশ্চিমে ওয়াটার ওয়াকার্স পর্যন্ত পুরো এলাকায় ডালের ব্যবসা ছিল যা রহমতগঞ্জের ঢাকাইয়ারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ঢাকাইয়াদের মধ্যে কাদের সরদারের ছিল লায়ন সিনেমা হল। ঢাকাইয়াদের মধ্যে প্রথম মোটরের ব্যবসা করেন মমিন সাহেব। যিনি ঢাকার জিঞ্জিরা থেকে নিজস্ব খরচে সৈয়দপুর পর্যন্ত মমিন মোটর কোম্পানি নামে নিজস্ব পরিবহন ব্যবসা চালু করেন।
কালের আবর্তনে ঢাকার আয়তন বাড়লেও বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহরের পরিচিতি আজো রয়ে গেছে। ঢাকার অলিগলির নামকরণ নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক জনশ্রুতি, আবার কোনো কোনোটি সম্পর্কে রয়েছে সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য। নামের সঙ্গে অনেক এলাকার এখন আর কোনো মিল নেই।
ঢাকার আদি সংস্কৃতি নানান মিশ্রণে গড়ে উঠে। ঢাকার নবাবরা কাশ্মির থেকে আসেন। তারা তাদের নিরাপত্তার জন্য শরীরচর্চাবিদ ও কুস্তিগীর রাখতেন। যারা মূলত উড়িষ্যার ছিল তাদের পাহলোয়ান বলা হতো। এ ধরনের পাহলোয়ানরা বাঙালি ঘরের মেয়েদের বিয়ে করে এ দেশেই বসবাস শুরু করেন। উর্দু-বাংলা-উড়িয়া এ তিনটি ভাষার সংমিশ্রণে ঢাকাইয়া ভাষার সৃষ্টি। নবাবরা উর্দুতে কথাবার্তা বলতেন। নবাব পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-দারোয়ান বিশেষ করে তারা উড়িষ্যা থেকে আসা লোক ছিলেন। নবাব বাড়ির কর্মচারীরা স্থানীয় বাঙালি মেয়েদের বিয়ে করে বাংলা এবং উড়িয়া ভাষার সংমিশ্রণ ঘটান। নবাবদের সঙ্গে উর্দুতে কথাবার্তা বলার জন্য উর্দু-উড়িয়া-বাংলার মিশ্রণে মৌখিক ভাষা সৃষ্টি হয়। এ ভাষা এখনো কুট্টিরা তাদের বাড়ির অভ্যন্তরে নিজস্ব ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন। এই সংমিশ্রণে কয়েকটি শব্দের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন চিংড়ি মাছকে জিংগা মাছ, সরিষার তেলকে কুয়োও তেল, নারিকেল তেলকে নারিকোলকা তেল এবং চেওয়া মাছকে পীড় বদরে মাছরে ইত্যাদি।
ঢাকাইয়ারা যেমন ভালো খাবার খেতে পছন্দ করেন, তেমনি খাওয়াতেও। আর খাওয়া-খাওয়ানোর এ নিয়মই যেন ঢাকাবাসীকে এনে দিয়েছে বিশেষ বিশেষ খাবারের ঐতিহ্য। এসব খাবারের মধ্যে কিছু ঢাকার অধিবাসীদের একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবন। আবার কিছু এসেছে পাকিস্তান ও ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে। ঢাকার খাবারের প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। তবে ঐতিহ্যবাহী অনেক খাবারই এখন আর পাওয়া যায় না। ঢাকার খাবারের আইটেমগুলোতে মোগলাই খাবারের প্রাধান্যই বেশি। তারা ভীষণ তেল-চর্বিযুক্ত খাবার পছন্দ করেন। তাদের খাবারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মসলার প্রাধান্য বেশি। ঢাকার হোটেল-রেস্তোরাগুলোতে পোলাও বা বিরিয়ানি যেন বাধ্যতামূলকই বলা যায়। বিরিয়ানির শহর ঢাকা। এ বিরিয়ানির ঐতিহ্য নিয়েই পুরনো ঢাকায় গড়ে উঠেছে বিরিয়ানির একাধিক ঐতিহ্যবাহী দোকান। পোলাও বা বিরিয়ানি মোগলাই খাবার হলেও এটা ঢাকায় প্রচলন করেন নবাব বাড়ির বাসিন্দারা। তবে পোলাও বা বিরিয়ানি ঢাকাবাসীর সম্পূর্ণ নিজস্ব খাবার না হলেও এ দুটোর মাঝামাঝি একটি খাবার ‘তেহারি’ তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন।
পোলাও বা সাদা ভাতের সঙ্গে তরকারির নানা উপকরণেও ঢাকাইয়াদের রয়েছে স্বতন্ত্র ঐতিহ্য। কালিয়া, চিকেন রোস্ট, রেজালা, দোপিয়াজা, দোলমা, কোফতা, টিকিয়া, বটি কাবাব, শামি কাবাব, হান্ডি কাবাব, নার্গিস কাবাব, আলুর দম, নানা প্রকার ভর্তা কিংবা চাটনি। তন্দুর বা কাশ্মিরি নান ঢাকাবাসীর কাছে অধিক প্রিয়। আর চালের রুটি দিয়ে ছোলার ডাল বা মাংসের তো তুলনাই হয় না। তন্দুর বা পরোটার সঙ্গে মুরগির গিলা-কলিজির ভুনা এখনো বেশ তৃপ্তি দিচ্ছে সকালের নাশতায়। কেউ বা নাশতা সারেন তন্দুর বা পরোটার সঙ্গে খাসির পায়া কিংবা গরুর পায়া দিয়ে তৈরি নেহারি দিয়ে। নাশতার জন্য কাবাব পরোটার পাশাপাশি সকাল কিংবা বিকালের নাশতাটা ঢাকাইয়ারা ডালপুরি, আলুপুরি, বাকরখানি, ফুলুড়ি, বেগুনি, ছোলাবুট, চটপটি, ফুচকা ইত্যাদি দিয়ে সারেন। তবে গরমে শরবত হিসেবে বরফকুচিসহ দইয়ের শরবত যা লাচ্ছি শরবত নামে পরিচিত, তা ঢাকাইয়াদের কাঠফাটা রোদে তৃষ্ণা মেটায়। রসগোল্লা, দইবড়া, শকরপারা, হালুয়া, বুন্দিয়া, বাদামের মিষ্টি, আমৃতি, নকুল দানা, চালকুমড়ার মুরব্বা, ছানা, সন্দেশ, বরফি, সনপাপড়ি, ফালুদা, ফিরনি, জর্দা ইত্যাদি ঢাকার মিষ্টান্নের শত বছরের ঐতিহ্য।
পুরনো ঢাকায় শত বছরের ইফতারি আইটেমের মধ্যে গতানুগতিক আইটেমগুলো হচ্ছে পিয়াজু, ছোলা, বেগুনি, আলুর চপ। আর এর সঙ্গে রয়েছে জালি কাবাব, শিক কাবাব, গুর্দা কাবাব, সুতি কাবাব, নার্গিস কাবাব, মাছ কাবাব, বড় মুরগি ভাজা, ডিমের দোপেয়াজা, টানা, বিফ-কিমা, কাশ্মিরি, পরোটা, নান খাতাই, নান রুটি, বাকরখানি, মোগলাই পরোটা, বিফ কোপতা, ঝাল কাচুরি, সিঙ্গাড়া, নেমকপাড়া, ফালুদা, দইবড়া, মাখনা, ক্ষীর, জরদা, শাহী হালিম, পনিরের সমুচা, দই, বম্বে জিলাপি, শাহী ফিরনি, বিভিন্ন পদের মুড়ি, মিষ্টি আর হালুয়া। এছাড়া মোরগ পোলাও, শাহী পোলাও, বুন্দিয়া পোলাও, সঙ্গে পাওয়া যায় কোরমা, রেজালা, কালিয়াসহ অর্ধ শতাধিক পদের ইফতার আইটেম। চকবাজারের ইফতারির বিশেষ একটি আইটেমের নাম ‘বড় বাপের পোলা খায়’।
ঢাকায় পঞ্চায়েত প্রথা ছিল। আর কেবল ঢাকায়ই নয়, পুরো বঙ্গদেশেই তা চালু ছিল। ১৯০৪ সালে নবাব সলিমুল্লাহ সরদারদের সংগঠিত করার চল্লিশ বছর আগে ঢাকা পৌর কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি হয়। এর বহু আগে থেকে এখানে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু ছিল। সরদারি প্রথার সঙ্গে পঞ্চায়েত প্রথার সম্পর্ক থাকলেও দুটি এক ছিল না। কারণ হিন্দু সমাজেও পঞ্চায়েত ছিল। কিন্তু ঢাকার সরদারদের মধ্যে কেউ হিন্দু ছিলেন না। বৃটিশদের অধীনে পঞ্চায়েত প্রথা ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ ‘হেডম্যান’ তথা এ সরদারি প্রথার পুনর্জন্ম দিলেন। পরে সলিমুল্লাহ ঢাকার হেডম্যানদের তথা সরদারদের ঐক্যবদ্ধ করেন।
ঢাকার সরদারদের জীবন-যাপন পদ্ধতি ছিল অতিশয় সাদামাটা ধরনের। সমাজের অপরাপর সাধারণ মানুষের মতোই তারা চলাফেরা করতেন। তবে তারা এক আশ্চর্যজনক চারিত্রিক বলে বলীয়ান ছিলেন। প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা নেশা করতেন না এবং মেয়েদের সম্পর্কে দৃঢ় চারিত্রিক বলে বলীয়ান হতেন। নারীঘটিত কোনো কলঙ্ক তাদের জীবনকে কখনো ছুতে পারতো না। ঢাকার সরদারদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া অনেকেই লেখাপড়া জানতেন। সবাই ধর্মভীরু, সাহসী এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তাদের প্রায় সবাই ছিলেন নিষ্কলঙ্ক সৎ ব্যবসায়ী। কেউ কেউ ঢাকার বাইরে গিয়েও ব্যবসা করতেন। ঢাকার সরদারদের প্রায় সবাই জীবনে কয়েকবার পৌর কমিশনার, নাহয় ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দাতা সদস্য ছিলেন তারা। জীবনে তারা বহু মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছেন। ঢাকার সরদারি প্রথা চালুর আগ পর্যন্ত পঞ্চায়েত পদ্ধতিই বিরাজমান ছিল। এক সময় এ শহরে ১৩৩ অথবা ১৩৫টি পঞ্চায়েত চালু ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ কর্তৃক মাত্র ২২ জন সরদারকে পাগড়ি পরিয়ে দেয়ার মধ্যে তার প্রমাণ মেলে। ঢাকাইয়া সরদার ছিলেন ২২ জন। এসব সরদারদের অধীন পঞ্চায়েতকে বলা হতো ২২ পঞ্চায়েত। ২২ পঞ্চায়েতের বাইরে বিশেষ করে ইংরেজ শাসকরা যে শাসন পদ্ধতি চালু করেছিল সেসব পদ্ধতির অধীন পঞ্চায়েতগুলোকে বলা হতো বারোয়ারি পঞ্চায়েত তথা বারো পঞ্চায়েত। প্রথম প্রথম বিভিন্ন এলাকার সরদাররা মনোনয়ন পেতেন নবাবদের কাছ থেকে। কিন্তু এক সময় মনোনয়ন প্রথা উঠে গিয়ে নির্বাচন পদ্ধতি চলে আসে।
ঢাকার এক একটা অঞ্চল, মহল্লা ও এক একটা সড়কের ইতিহাস নিয়ে রোমান্টিক উপন্যাসের চেয়েও চিত্তাকর্ষক কাহিনী রচনা করা যায়। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মোহাম্মদ আজমের সুবেদারি আমলে ঢাকার বর্তমান আজিমপুর এলাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য গৃহনির্মাণ করা হয়েছিল বলেই এলাকার নামকরণ আজিমপুর করা হয়। তেমনি মন্দিরের নামানুসারে সংশ্লিষ্ট এলাকার নাম ঢাকেশ্বরী রোড করা হয়েছে। এলাকার একটি ছোট ঝিলের (নদী) নামানুসারে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার নামকরণ করা হয়েছে। যদিও আজ ঝিলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তৎকালীন বিশিষ্ট জমিদার মৌলভী আবদুল আলীর নামানুসারে মৌলভীবাজারের নামকরণ করা হয়েছে। কুটির শিল্পের আকারে টিকিয়া তৈরি হতো এলাকায়, সেই এলাকাটি আজ টিকাটুলি নামে পরিচিত। গেণ্ডারিয়া ও আশপাশের এলাকায় অধিক আখ উৎপন্ন হতো বলে এ এলাকার নাম গেণ্ডারিয়া রাখা হয়। আজকের আবাসিক এলাকা ধানমন্ডিতে ব্রিটিশ যুগে চাষাবাদ হতো। কিছু কিছু বসতিও ছিল। তবে ধানটান উৎপন্ন হতো বলে ধানমন্ডি নামকরণ হয়নি। এক সময় সেগুনবাগিচায় প্রচুর সেগুন গাছ ছিল। পরবর্তীকালে সেগুন বাগান সাফ করে স্থানটিকে আবাসিক এলাকায় পরিণত করা হয়েছে। সেগুন সাফ হলেও এলাকাটির নাম পরিবর্তন হয়নি। এখনো সেগুনবাগিচা নামেই পরিচিত। গাবতলী এলাকাটিতে এক সময় প্রচুর গাবগাছ ছিল বলে স্থানটির নাম গাবতলী হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করার উদ্দেশ্যে ইসলাম খা বুড়িগঙ্গা থেকে একটি কৃত্রিম খাল খনন করান, খালটি বাবুবাজার থেকে শুরু করে জিন্দাবাহারের উত্তর দিক হয়ে তাতীবাজারের পাশ দিয়ে গোয়ালনগর তারপর নবাবপুর, মুহসেন্দী ও নারিন্দা রোডের সম্মুখ দিয়ে ঘুরে শরাফতগঞ্জ হয়ে বর্তমান লোহার পুলের নিচ দিয়ে আবার বুড়িগঙ্গায় মিশে যায়। এ স্থানে ইসলাম খার আসার আগে থেকে যে একটি খাল ছিল তা রেনেলের ম্যাপে দেখা যায়। আর এ খালের মাথায় বুড়িগঙ্গার দু’ধারে পাঠানদের দুর্গ ছিল যা বেগ মুরাদের কেল্লা নামে পরিচিত হতো। ম্যাপে তাও চিহ্নিত হয়েছে। ধোলাইখাল ভরাট করে সেখানে নির্মিত হয়েছে ঢাকার ব্যস্ততম রাস্তা। তবে আজো ধোলাইখাল নামে পরিচিত।
ঢাকার অনেক মহল্লাই হিন্দু প্রধান ছিল এবং সে মহল্লায় যে পেশা বা গোত্রের লোকসংখ্যা বেশি ছিল সেসব স্থানের নাম সেই গোত্র বা পেশাজীবীর নামানুসারে; স্বামীবাগ, জালুয়া নগর, গোয়ালনগর, বানিয়ানগর, সুতারনগর, কামারনগর, কুমারটুলি, চামারটুলি, গণকটুলি, মালাকারটোলা, করাতিটোলা, শিংটোলা, শাখারীবাজার, ইত্যাদি। মুসলমান মহল্লাগুলোর নাম মোগল আমলের নামের ঐতিহ্যই বহন করে আসছে। যেমন মোগলটুলি, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, নবাবগঞ্জ, নবাববাগিচা, রহমতগঞ্জ, মনোয়ার খা বাজার, বেগম বাজার, নাজিরা বাজার, চৌধুরী বাজার, ইসলামপুর, নবাবপুর, কসাইটুলি, আজিমপুর, শাহবাগ ইত্যাদি।
ঢাকায় অনেকগুলো পুল ছিল। দু’ধারে পারাপারের জন্য ব্রিজ বা সেতুকে ঢাকাবাসী ডাকত ‘পুল’ বলে। মোগল আমলে শুধু ধোলাইখালের ওপরই ১০টি পুল নির্মিত হয়েছিল। আজ আর সেসব পুল নেই। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে পুলগুলোর অস্তিত্ব। তবু এলাকাগুলো ওই পুলের নামেই পরিচিত। আবার এসব পুলের সঙ্গে প্রচলিত কিছু কাহিনীও জড়িয়ে আছে। লোকজন বিশ্বাস করতো, বহুকাল আগে ফকিরাপুলে চারজন ফকিরের কবর ছিল। সেই কবরগুলোর ওপর হঠাৎ এক রাতে একটা সাকো হয়ে যায়। সেই থেকে ওই সাকোটি ‘ফকিরের পুল’ বা লোকমুখে ফকিরাপুল বলে পরিচিত হয়ে পড়ে। বিশ্বে তখন সবেমাত্র ‘সাসপেনশন ব্রিজ’ বা ঝুলন্ত সেতুর ব্যবহার শুরু হয়েছে। সেই ঝুলন্ত লোহার সেতু তৈরি হলো ঢাকায়। উনিশ শতকে সেই লোহারপুল হয়ে উঠে ঢাকার অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান।
ইতিহাসের এমন অনেক কুখ্যাত ও অত্যাচারিত ইংরেজ শাসকরা রয়ে গেছেন ঢাকায়। এখনো সদর্পে আছেন মি. আয়ার, জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলার, ল্যান্সলট হেয়ার, ডা. জেমস ওয়াইজ, মি. ইংলিশ, লর্ড মিন্টো, লর্ড কার্জন। মিন্টো রোড হাল আমলে মন্ত্রীপাড়া হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বাসভবনগুলো মিন্টো রোডে। ওয়ারি এলাকাটি ব্রিটিশ সরকার একটি অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেন। এ এলাকার জমি পদস্থ সরকারি চাকুরেদের মধ্যেই সাধারণত বণ্টন সীমাবদ্ধ রাখে। বণ্টনকালে সরকার শর্ত দিয়েছিল, বিঘাপ্রতি ছয় টাকা কর এবং তিন বছরের মধ্যে বাড়ি তৈরি করতে হবে। ওয়ারিতে আছে উদ্ভিদ উদ্যান ‘বলদা গার্ডেন। প্রচুর দূর্লভ গাছপালা বেষ্টিত বলধা গার্ডেনের সূচনা করেন তদানীন্তন ঢাকা জেলা, বর্তমান গাজীপুর জেলার বলধার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী।
ব্রিটিশ ভারতে যে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই অঞ্চলে শিক্ষার আলোকবর্তিকা ছড়িয়েছে তার বেশিরভাগ ঢাকার পুরনো অংশে। শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (বিলুপ্ত জগন্নাথ কলেজ), নটর ডেম কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, পোগোজ স্কুল, সরকারি মুসলিম হাইস্কুল, আরমানিটোলা সরকারি স্কুল, সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গালর্স হাইস্কুল, সরকারি কবি নজরুল কলেজ। বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন সরকারি ও বেসরকারি স্কুল যথাক্রমে ঢাকা কলেজিয়েট ও পোগোজ স্কুল যথাক্রমে ১৮৩৭ এবং ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। এ দেশের শিক্ষা বিস্তারে প্রধান ভূমিকা পালন করে এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর ঢাকার দ্বিতীয় সরকারী স্কুল আরমেনীয়দের স্মৃতি বিজড়িত আরমানিটোলা সরকারি স্কুল। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশের বাইরে রাষ্ট্রনায়কসহ দেশের রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, মন্ত্রী, এমপি, অধ্যাপক রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, আইনজীবী, ব্যবসায়ীসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত হাজারো ব্যক্তিত্বের জš§ দিয়েছে। বঙ্গবঙ্গ রদের পর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের সব ধরনের স্বাধীকার আন্দোলনসহ মহান ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
সমৃদ্ধ ঢাকার ইতিহাস ঘাটলে মসজিদ পাওয়া যায় অনেক। প্রায় সাত হাজার ছোট বড় মসজিদ রয়েছে শুধু ঢাকা শহরেই। এজন্য মসজিদের শহরও বলা হয় ঢাকাকে। ঢাকার ইতিহাসে নজর দিলে দেখা যায় সময়ের বিবর্তনে এখানে রয়েছে নানান স্থাপত্যরীতির মসজিদ। একুশ শতকের এই সময়ে এসে ঢাকার মসজিদগুলোর স্থাপত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেও পুরনোগুলো এখনো দৃষ্টিনন্দন। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম নিদর্শন মসজিদের শহর ঢাকা বিশেষ স্থান রয়েছে।
নারিন্দার বিনত বিবি জামে মসজিদ এখানকার প্রথম মুসলিম স্থাপত্য। ঢাকার সবচেয়ে পুরনো স্থাপত্য বলেও স্বীকৃত। ধারণা করা হয়, ১৪৫৬ খ্রিস্টব্দে ইসলাম খাঁর আগমনের প্রায় দেড়শ বছর আগে বাংলার সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের আমলে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি নির্মিত হয়। অনেকের মতে, নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে (১৪৩৫-১৪৫৯) মার মারহামাতের মেয়ে মুসাম্মদ বখত বিনত ১৪৫৭ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর একটি। যা প্রায় ৬০০ বছর আগেকার প্রতিষ্ঠিত।
প্রাচীন চুড়িহাট্টা মসজিদ বা চুড়িহাট্টা মসজিদ বাংলাদেশের একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা ঢাকা মহানগরের পুরনো ঢাকার উমেশ চন্দ্র দত্ত লেন ও হায়দার বকশ লেনের তেমাথায় অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে মসজিদটি চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। মসজিদটির প্রকৃত অবস্থান ছিল চকবাজারের সামান্য পশ্চিম দিকে ২৬-২৭ শেখ হায়দার বকশ লেন। ঐতিহাসিক তথ্যমতে মসজিদটি ৩৭০ বছর পুরনো। তবে প্রাচীন মসজিদ স্থাপত্যটি বর্তমানে বিলুপ্ত; সে জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক স্থাপত্য।
মুসা খান মসজিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শহীদুল্লাহ হলের পশ্চিম পার্শ্বে এবং খাজা শাহবাজ খান মসজিদ থেকে দক্ষিণে অর্ধ কিলোমিটারের চেয়েও কম দূরত্বে অবস্থিত। একটি উঁচু খিলান ছাদ বিশিষ্ট ভিতের উপর তিন গম্বুজ মসজিদ এবং এর উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত মুসা খান এর কবর নিয়ে মুসা খান মসজিদ কমপ্লেক্স গঠিত। জনশ্রুতি অনুযায়ী বলা হয় যে, মসজিদটি বারো ভূঁইয়া প্রধান ঈসা খান এর পুত্র মুসা খান (মৃত্যু ১৬২৩ খ্রি) নির্মাণ করেন।
‘সাত গম্বুজ মসজিদ’ প্রায় ৩৫০ বছর ধরে মোঘল আমলের স্থাপত্যশৈলী ও ইতিহাসের কথা জানান দিচ্ছে মসজিদটি। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৬৮০ সালের দিকে নবাব শায়েস্তা খাঁ’র পুত্র উমিদ খাঁ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘হলুদ মসজিদ’। মসজিদটির পুরো নাম ‘ধনু বেপারি হলুদ মসজিদ’। রাজধানী ঢাকার নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডে অবস্থিত। নির্মাণের নির্ধারিত দিনক্ষণ জানা না গেলেও মসজিদটি শত বছরের পুরনো। ধনু বেপারি হলুদ মসজিদটিকে বেশির ভাগ মানুষ ‘হলুদ মসজিদ’ নামেই বেশি চেনে। এটি শুধু নারিন্দার ঐতিহ্য নয় বরং পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্থাপত্যের একটি।
আরমানিটোলার আবুল খয়রাত রোডে অবস্থিত তারা মসজিদ। এটি ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার কোনো তারিখযুক্ত শিলালিপি নেই। মির্জা গোলাম পীর সতেরো শতকে দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরে নির্মিত মোগল স্থাপত্যশৈলী অনুসরণে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
ঢাকার ছড়ানো ছিটানো মুক্তিযুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন কিংবা গণকবরেরও অস্তিত্ব বা স্মৃতিচিহ্ন নেই। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ছড়ানো ছিটানো মুক্তিযুদ্ধের এমন নানান নিদর্শনের অস্তিত্ব বা স্মৃতি চিহ্ন এখন নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশুপার্কের যে জায়গা এখন ঢেকে আছে পুষ্প-পল্লবে, একাত্তরের ৭ মার্চ সেখানেই অঙ্কুরিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ। ওইদিন বিকেল সোয়া ৩টায় দীপ্ত পায়ে জনতার মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেদিন রমনার রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর মাত্র ১৭ মিনিটের বক্তৃতায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্য রচিত হয়। যার পরিণতিতে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা রেসকোর্সের এ ময়দানেই আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতার অন্যতম এই নিদর্শন এখন শিশুপার্ক এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে।
ঐতিহাসিক, নান্দনিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনায় এনে পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকাকে ঐতিহ্যবাহী ভবন বা স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এই হেরিটেজ বা ঐতিহ্যের তালিকা করে। একই সঙ্গে হেরিটেজ ঘোষিত এলাকা হিসেবে ঋষিকেশ রোড, রেবতি মোহন দাস রোড, বি কে দাস রোড, ফরাশগঞ্জ রোড, শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজার, পানিটোলা, প্যারিদাস রোড ও হেমন্ত দাস রোডের নাম তালিকাভুক্ত করে। কিন্তু সেসব সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। নজরদারির অভাবে ভেঙ্গে সেখানে উঠছে বহুতল অট্টালিকা।
ইতিহাস ভুলে গেলে যেমন একটি জাতি হারিয়ে ফেলে তার আত্ম-পরিচয়। তেমনি আধুনিক মেগা সিটি হলেও ঢাকার পরিচয়ও তার ইতিহাসের মধ্যে নিহিত। একুশ শতকের ঢাকা তার আত্ম-পরিচয়কে লালনের মাধ্যমে অনন্য এক শহরের মর্যাদা লাভ করতে পারে। ঢাকার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো এ শহরের মসজিদ এবং অন্যান্য উপসনালয়ের নির্মাণ শৈলী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ঢাকার সংস্কৃতি বৈচিত্র্যকে ধারণ করেই সমৃদ্ধ হয়েছে। এ কালের ঢাকাও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেই এগিয়ে চলেছে। শত বছরের ঢাকার এই ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ব্র্যান্ডিং করে দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করা যেতে পারে। এই সুযোগটি আমাদের নেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটন খাতে বিপুল আয় করছে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে আমাদের পর্যটন খাত বিকাশের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment