আর্জেন্টিনার ভয়াবহ বিপর্যয়
সংবাদ বাংলা: আর্জেন্টিনা তাদের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ফলাফলের নতুন রেকর্ড থেকে মাত্র এক গোল দূরে ছিল কাল। হোক না প্রীতি ম্যাচ, এই অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা আর্জেন্টিনাকে তাড়িয়ে বেড়াবে বহু দিন। বিশ্বকাপের আগে একটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে পারে আর্জেন্টিনা। না হলে আপাতত যা সূচি, তাতে ৬-১-এর দুঃস্মৃতি নিয়ে নামতে হবে বিশ্বকাপে।
আর এর দায় নিতে হবে ৫৮ বছর বয়সী সাম্পাওলিকে। স্পেন নিজেদের মাঠে খেলছে। ১৭ ম্যাচ ধরে অপরাজিত। এমন একটা ম্যাচে সাম্পাওলি একাদশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গেলেন। আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে আভাস দিয়েছিলেন, এখনো বিশ্বকাপের দল খুঁজে পাননি। তাই বলে এতটা!
গত ম্যাচে মেসিকে ছাড়াই ইতালিকে ২-০ গোলে হারিয়েছে আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচের দুই গোলদাতাকে এ ম্যাচে প্রথম একাদশে রাখলেনই না। একজনকে তো পাঠিয়ে দিলেন ভিআইপি বক্সে মেসির সঙ্গে খেলা দেখতে! অথচ যে জায়গায় সাম্পাওলির পরিবর্তন আনা সবচেয়ে জরুরি, সেই গঞ্জালো হিগুয়েইনকে আরও একটা ম্যাচে সুযোগ দেওয়ার খেসারত গুনেছেন। প্রথমার্ধে অন্তত দুটি সুযোগ নষ্ট করেছেন হিগুয়েইন। এর একটি তো গোলমুখে ‘ট্যাপ ইন’ করলেই গোল হয় এমন অবস্থায়। গোলমুখের এত কাছে ছিলেন, বাইরে বল পাঠানোই ছিল সবচেয়ে কঠিন। হিগুয়েইন কঠিন বিকল্পটাই বেছে নিলেন। আলতো টোকায় বল বল জালে পাঠানোর বদলে হিগুয়েইন হাফ ভলি করলেন, বল মাটিতে সজোরে লেগে ক্রস বারের ওপরে। খোদ গোলরক্ষক ডি গিয়া বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বলটা জালে যায়নি!
আরেকটা বক্সের প্রান্ত থেকে সুবিধাজনক জায়গায় থেকেও এমন দুর্বল শট নিলেন! প্রথমার্ধে স্পেনের চেয়ে গোলে বেশি শট নিয়েও তাই আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকল। স্পেন দুটি সুযোগ থেকে দুটিতেই গোল করেছে। আর্জেন্টিনা সেখানে চার শট নিয়ে গোল করেছে একটিতে। প্রথমার্ধে ২-৩, এমনকি ২-২ গোলে সমতা থাকলেও এই ভয়াবহ ফল বিপর্যয় হতো না। মেসি নেই, আগুয়েরো নেই। হিগুয়েইন ছাড়া বিকল্পও ছিল না আর্জেন্টিনার। কিন্তু এই অবস্থাও তৈরি করেছেন সাম্পাওলি নিজে। স্কোয়াডে মাউরো ইকার্দি কিংবা পাওলো দিবালার মতো খেলোয়াড়দের রাখেনইনি। সাম্পাওলি অবশ্য হিগুয়েইনকে ছেঁটে ফেলেও মাঝে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তখন ইকার্দি যথেষ্ট সুযোগ পাননি। মেসি থাকার পরও দিবালাকে জায়গা করে দেওয়ার মতো উপায়ও সাম্পাওলির ঘটে ধরেনি। এই দুজনের জন্য বিশ্বকাপের দরজা এক রকম বন্ধই করে দিয়েছেন। ইতালিয়ান লিগের এই মৌসুমের দ্বিতীয় আর তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতাকে (ইকার্দি-দিবালা) ছাড়াই বিশ্বকাপে যেতে চাইছেন সাম্পাওলি!এমন ইঙ্গিত তিনি আগেই দিয়েছেন। কালকের ম্যাচের পর সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন। এটাই আর্জেন্টিনা সমর্থকদের জন্য আপাতত একমাত্র সুখবর। হিগুয়েইনের নিজের খেলার মধ্যেই আত্মবিশ্বাসের ছাপ নেই, ক্ষুধা নেই। ক্ষুরধার গতি নেই। বক্সের আশপাশে অলস ঘুরেছেন। বেশির ভাগ সময় জায়গামতো ছিলেন না।
আক্রমণের পর মাঝমাঠ। সেখানে লুকাস বিলিয়া, এভার বানেগা আর হাভিয়ের মাসচেরানো ত্রয়ীকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছেন। বানেগা স্প্যানিশ লিগে দারুণ ফর্মে আছেন। কিন্তু তাঁর দুপাশের দুই সঙ্গীর অবস্থা এতটাই খারাপ, নিজেও ভোঁতা হয়ে রইলেন। মাসচেরানো আর বিলিয়া দুজনই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ক্লাব ক্যারিয়ারটাই নিভু নিভু। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে মাসচেরানো মাঝমাঠ ছেড়ে হয়ে গিয়েছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড। এখন গেছেন চীনের ফুটবলে। তাঁকে দিয়ে মাঝমাঠে আক্রমণ গড়তে চাইছেন সাম্পাওলি? সিরিয়াসলি!
বুড়ো ঘোড়ায় বাজি ধরার ফলটা ভুগেছেন সাম্পাওলি। অথচ স্পেনের বিপক্ষে খেলতে হলে ভারী মাঝমাঠ নিয়ে খেলতে হবে। আক্রমণের সুনামি-ধাক্কাটা যেন মাঝমাঠের উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীতে লেগে দুর্বল হয়ে যায়। কাল মাঝমাঠে আর্জেন্টিনা বল পুনরুদ্ধারই করতে পারল না। ভুল পাসে উল্টো বল ঠেলে দিল ইনিয়েস্তা, থিয়াগো, কোকেদের পায়ে। ফলাফল, কেউ যাবে না খালি হাতে স্লোগান নিয়ে স্পেন গোল করে গেল একের পর এক। আর আর্জেন্টিনার রক্ষণ! তাদের চিরায়ত বেহুলা-বাসর। যত অটুট করে বানানোর চেষ্টা হোক, ছিদ্র তাতে থাকবেই। এটা সত্যি, আর্জেন্টিনা কাল প্রথমার্ধে খেলায় ফিরেছিল রক্ষণের কারণেই। নিকোলাস ওটামেন্ডির দুর্দান্ত হেডার ২-১ করে দিয়েছিল। আর প্রথমার্ধে লো চেলসো যেভাবে স্পেনের রক্ষণ চিঁড়ে ঢুকে পড়ছিলেন, আরেক তরুণ মেজাও দিচ্ছিলেন প্রতিভার পরিচয়; তখনো আর্জেন্টিনা ম্যাচ ছিল ভালোমতোই। কিন্তু কালকের ৫টি গোল আর্জেন্টিনার দুর্বল রক্ষণের কারণে। প্রথম গোলটির কৃতিত্ব স্পেনের মাঝমাঠ আর দ্য বিস্ট ডিয়েগো কস্তাকে দিতে হবে। সেই গোল ঠেকাতে গিয়ে কস্তার সঙ্গে সংঘর্ষে চোট নিয়ে মাঠ ছেড়ে গেলেন সার্জিও রোমেরো। বদলি হিসেবে নামলেন বুড়ো কাবায়েরো। ইতালি ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেছেন এটা সত্যি। কাল কাবায়েরো বেশির ভাগ গোলে ডাইভ দেওয়ারই অবকাশ পেলেন না যেন!
তাতে তাঁর দুর্বলতার চেয়ে অপ্রস্তুত রক্ষণকে দায় নিতে হবে বেশি। দুবার ভুল পাসে উল্টো স্পেনের আক্রমণভাগকে বল নিজেদের গোলমুখে তুলে দিয়েছে আর্জেন্টিনা। একবার অমনোযোগী রক্ষণকে দেখতে পেয়ে ডি গিয়ার লম্বা বল থেকে হজম করতে হয়েছে গোল। ইসকোর হ্যাটট্রিকের তিনটি গোলই এসেছে তাঁকে আনমার্কড করে রাখার কুফল হিসেবে। গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠেছিল তাদের রক্ষণের কারণে। এই বাস্তবতা অনেকে মানতে চান না। কোচ হিসেবে আলেহান্দ্রো সাবেয়া ছিলেন চতুর। তিনি জানতেন ভাত দিয়ে পোলাও রান্না হয় না। রসুইঘরে যা ছিল, তিনি তা দিয়েই রান্না করেছেন। দুঃখজনক হলো, গত বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবের নজর কাড়া মার্কোস রোহো এখন মাঝারি কোনো ক্লাবের সাইডবেঞ্চেও জায়গা পাওয়ার মতো অবস্থায় নেই। রোমেরোও ইউনাইটেডের বেঞ্চে বসে থেকে থেকে ধার হারিয়েছেন। এই আর্জেন্টিনার গোলরক্ষকে ভরসা নেই। ডিফেন্স যা তা। মাঝমাঠ বুড়োদের দখলে। আক্রমণে হিগুয়েইন এখন মিস করতে করতে ‘মিসেস হিগুয়েইন’ হয়ে ওঠার পর্যায়ে। এই আর্জেন্টিনার আছে কেবল এক লিওনেল মেসি। মেসি-বিহীন আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা-বলিভিয়া মাপের দল; সেটা আবারও পরিষ্কার হলো। বাছাই পর্বেও দেখা গেছে। বাছাই পর্বে মেসি খেলেনি এমন ১২.৫ শতাংশ ম্যাচে জিতেছে আর্জেন্টিনা, মেসি খেলেছেন এমন ম্যাচে জয়ের হার যেখানে ৬০ শতাংশ। শেষ ম্যাচে মেসি ত্রাণকর্তা না হলে এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা হয়ে যেত দর্শক।
কিন্তু একা মেসি আর কী করবেন? ছিয়াশি বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার পাশে তবু বুরুচাগা-ভালদানোরা ছিলেন। এই মেসির পাশে কেউ নেই। ম্যাচের মাঝপথে বিরক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট বক্স থেকে উঠে যাওয়া যায়। কালকে ওভাবে মেসিকে উঠে যেতে দেখে মনে হলো, আফসোস বিরক্ত হলেও মেসির মাঠ ছেড়ে উঠে যাওয়ার সুযোগ নেই! এই আর্জেন্টিনাকে নিয়ে সমর্থকদের বেশি আশা না করাই ভালো। মেসি নিজে সত্যিটা বলেছেন, এবার আর্জেন্টিনা ফেবারিট নয়। একটাই ইতিবাচক দিক হলো, দুই মাসের মতো সময় পাবেন সাম্পাওলি। শুধু ভাবার জন্য। নিজের মুণ্ডিত মস্তকের তালু চুলকে কিছু একটা উপায় বের করতে পারলেই ভালো!
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment