আল্লাহ’র সন্তুষ্টির আশায় রোজা
সংবাদ বাংলা: আল কোরআনের পরিভাষায় রোজাকে বলা হয় ‘সাওম’। আরবি ‘সাওম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘বিরত থাকা’। এ প্রসঙ্গে সূরা মরিয়মে উল্লেখিত হযরত ঈসা (আ.)’র মা হযরত মরিয়মের একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়: ‘আমি পরম করুণাময়ের জন্য রোজার মানত করেছি। এ কারণে আজ আমি কারও সাথে কথা বলব না।’ -সূরা মরিয়ম: আয়াত ২৬। এখানে মা মরিয়মের বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, যেহেতু তিনি রোজা রেখেছেন, সেহেতু তিনি কারো সাথেই কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ‘সাওম’ বলতে বুঝায়, ‘আল্লাহ’র সন্তুষ্টির আশায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খাদ্য-পানীয় এবং যৌনতা থেকে বিরত থাকা।
রোজার উদ্দেশ্য: পবিত্র কোরআন মজিদে রোজা বা সাওম সাধনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরাজ করা হল যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে পারো।’ -(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৮৩)। তাক্বওয়া আল কোরআনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক পরিভাষা। এটি ইসলামী আধ্যাত্মবাদ এবং নৈতিকতার মূলকথা। এটি ঈমানদার বা বিশ্বাসীদের জীবনের একটি একটি গুণাবলী যার বলে তারা তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে চিন্তা এবং কর্মে আল্লাহ’র অস্তিত্বকে অনুভব করে, তাঁকে স্মরণ করে, তাঁকে হাজির-নাজির জেনে এবং ভয় করে নিজেদের জীবন পরিচালনা করেন। যার মধ্যে তাক্বওয়ার গুণাবলী রয়েছে, তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহ’র জন্য নেক আমল করতে এবং গুনাহ বা নাফরমানি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। তাক্বওয়া হল এমন এক নৈতিক বোধ, যার ফলে ঈমানদারগণ নেক আমল করতে এবং আল্লাহ’কে ভয় করে চলতে ব্রতী হয়। তাক্বওয়া মানুষের মধ্যে ধৈর্য্য এবং দৃঢ়তা তৈরি করে। এটি মানুষের মধ্যে সহনশীলতা তৈরি করে এবং ধৈর্য্য ও সহনশীলতা মানুষকে উচ্চ নৈতিকতার স্তওে উন্নীত হতে সাহায্য করে।
রোজা রাখা ফরজ: হিযরতের দ্বিতীয় বৎসরে রোজা ফরজ হয়। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা বাকারায় প্রতি বছর রমজান মাসে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য রোজা রাখা ফরজ বা বাধ্যতামূলকের বিধান দিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন: হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরাজ করা হল যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে পারো।’ -(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৮৩)। একই সূরার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আরো বলেন: ‘রমজান সেই মাস, যে মাসে পবিত্র কোরআন নাযিল করা হয়েছে, যা সমগ্র মানবজাতির জন্য জীবন-যাপনের বিধান এবং সুস্পষ্ট উপদেশাবলীতে পরিপূর্ণ যা সঠিক ও সত্যপথ প্রদর্শন করে এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরে।’ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর কয়েকটি বিবৃতির মাধ্যমে এ বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যা হাদীসের গ্রন্থগুলোতে বিধৃত করা হয়েছে। ইমাম আল বুখারী (র.) এবং ইমাম আল মুসলিম উভয়ই তাঁদের গ্রন্থে ইবনে উমর (রা.)’র বরাত দিয়ে বলেছেন, রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর স্থাপিত: ১. আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল – এ কথার বিশ্বাস, ২. নামাজ, ৩. যাকাত, ৪. হারাম শরীফে হজ্জ আদায় এবং রমজান মাসে রোজা রাখা।
যেসব কারণে রোজা না রাখার অনুমতি আছে–
রমজানের রোজা রাখা ফরজ। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের জন্য। তবে কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলোর কারণে রমজান মাসে রোজা না রাখার সুযোগ আছে। কোরআন হাদিসের আলোকে ইসলামি স্কলাররা এর বর্ণনা দিয়ে বলেছেন-
১. অসুস্থতার কারণে রোজা রাখার শক্তি না থাকলে বা রোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে। (পরে কাজা করে নেবে)। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কেউ রমজান মাস পাবে, সে যেন রোজা পালন করে। আর যে ব্যক্তি রোগাক্রান্ত বা সফরে থাকে সে যেন অন্য সময়ে তা আদায় করে নেয়।’ -সূরা বাকারা: ১৮৫
২. গর্ভবর্তী মহিলা রোজা রাখলে যদি নিজের বা সন্তানের জীবনের ব্যাপারে আশঙ্কা করে।
৩. যে মহিলা নিজ বা অন্যের বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান, তিনি রোজা রাখলে যদি বাচ্চার কষ্ট হবে মনে করেন, তাহলে রোজা না রেখে পরে কাজা করতে পারবেন।
৪. শরয়ি মুসাফির (কমপক্ষে ৪৮ মাইল ভ্রমণ করেছেন যিনি) তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে কষ্ট না হলে রোজা রাখা উত্তম। অবশ্য নিজের বা সঙ্গীদের কষ্ট হলে রোজা না রাখাই উত্তম।
৫. যদি রোজা রেখে সফর শুরু করে, তাহলে সে রোজা পূর্ণ করা জরুরি। আর যদি খেয়ে সফর থেকে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়, তাহলে বাকি দিন খাওয়া-পানাহার বাদ দেওয়া উত্তম। আর যদি না খেয়ে শুরু করে এরপর বাড়ি পৌঁছানোর পরও রোজার নিয়ত করার সময় থাকে, তাহলে রোজার নিয়ত করে নেবে।
৬. কেউ কাউকে রোজা রাখলে হত্যার হুমকি দিল বা কোনোভাবে রোজা না রাখার ওপর বাধ্য করলো- তাহলে রোজা না রেখে পরে কাজা করে নিতে পারেন।
৭. ক্ষুধা বা পিপাসা যদি এত বেশি হয় যে, কোনো দ্বীনদার অভিজ্ঞ ডাক্তার প্রাণনাশের আশঙ্কা করেন, তাহলে রোজা ভাঙা যাবে। তবে পরে কাজা করে নিতে হবে।
৮. মহিলাদের ঋতুকালীন সময়ে বা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরবর্তী অসুস্থকালীন সময়ে রোজা রাখা যাবে না। তবে পরে কাজা করে নিতে হবে।
রোজা ভাঙার কারণ: রোজা ভঙ্গের অনেক কারণ রয়েছে। রোজা নিয়ে যেসব বই রয়েছে বা সিয়ামের আহকাম-সংশ্লিষ্ট যে বইগুলো রয়েছে, সেগুলো থেকে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তারপরও রোজা ভঙ্গের মৌলিক বিষয়গুলো আমরা বলতে পারি।
সিয়াম ভঙ্গের জন্য প্রথমত যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো—স্ত্রী সহবাস অথবা স্বেচ্ছায় যেকোনো ধরনের যৌনকাজে সম্পৃক্ত হওয়া। এটি সিয়াম নষ্ট করে দেয়। তাই কেউ যদি স্বেচ্ছায় কোনো যৌন চাহিদা পূরণ করার জন্য চেষ্টা করেন, সেটা স্ত্রী সহবাস অথবা যেকোনোভাবে হোক না কেন, তাহলে তার সিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে পানাহার করা। স্বেচ্ছায় যদি কোনো ব্যক্তি পানাহার করেন, তাহলে তার সিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে। তৃতীয় বিষয়টি একটু দীর্ঘ আলোচ্য বিষয়। সেটা হচ্ছে পানাহারের অর্থ যেখানে পাওয়া যায়, অর্থাৎ যে কাজের মধ্যে পানাহারের অর্থ পাওয়া যায়, সে কাজগুলোও সিয়ামকে নষ্ট করে। যেমন আপনি যদি ধূমপান করেন, তাহলে আপনার সিয়াম নষ্ট হবে। অথবা আপনি কিছু গিলে ফেললেন, যেমন—পাথর বা এই জাতীয় কিছু আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে সিয়াম নষ্ট হবে। তবে যদি থুতু গিলে থাকেন, তাহলে সিয়াম নষ্ট হবে না, কারণ থুতু পানাহারের মতো বিষয় নয়। এটা শরীরের অভ্যন্তরীণ একটা বিষয়। আর পানাহারের অর্থ নেই যে বিষয়গুলোতে সেগুলো সিয়াম নষ্ট করে না, যেমন—চোখে ড্রপ দিলে, কানে ড্রপ দিলে, ইনসুলিন নিলে, ইনজেকশন নিলে সিয়াম নষ্ট হবে না। কিন্তু পানাহারের অর্থ পাওয়া যায় এমন ইনজেকশন বা স্যালাইন নিলে, যেগুলো খাদ্যের কাজ করে, শক্তিবর্ধক অথবা খাদ্যের ব্যবস্থা আছে, সেই স্যালাইন যদি কেউ নিয়ে থাকেন, তাহলে তার সিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে। সিয়াম ভঙ্গের মৌলিক বিষয় হচ্ছে তিনটি। প্রথমত, স্ত্রী সহবাসসহ যেকোনো ধরনের যৌনাচার। দ্বিতীয়ত, পানাহার বা খাদ্য গ্রহণ করা। তৃতীয়ত, পানাহারের অর্থ যেগুলোর মধ্যে রয়েছে, সেগুলো সিয়াম নষ্ট করে থাকে।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment