ঈদের স্মৃতি
আনিসুল হক: বড়দের জন্য ঈদ কিন্তু খুলে দেয় স্মৃতির জানালা! আমার তো ঈদের দিন শৈশবের কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের দুটো গাভি ছিল। দুটো বাছুর হলো। আমাকে একটা বাছুর দিয়ে বলা হলো, ‘এটাকে তুমি পালবে। এটা তোমার।’ আরেকটা দেওয়া হলো আমার বোনকে। আমরা দুজনেই দুটো বাছুরকে খুব যত্ন করতাম। আস্তে আস্তে বাছুর দুটো বড় হলো। এক কোরবানি ঈদের আগে গরু দুটোকে বিক্রি করে দেওয়া হলো। তখন খুব মন খারাপ হয়েছিল।
আর কোরবানির ঈদের সময় আমার কাজ ছিল জবাইয়ের পর গরুর একটা ঠ্যাং ধরে রাখা। চামড়া ছেলা চলছে। আমি একটা পা ধরে আছি। ভুঁড়ির ওপরের একটা আস্তর আমি নিয়ে নিতাম। কৌটার মুখে সেটা লাগাতাম। শুকিয়ে গেলে সেটা খুব ভালো ঢাক হতো। পাটখড়ি দিয়ে সেই ঢাক বাজিয়ে পাড়া মাথায় তুলতাম।
আরেকটা কাজ করতাম। কোরবানির মাংস রান্না হচ্ছে। কাঠের চুলা। মাংস কেবল সেদ্ধ হচ্ছে। মসলার ঘ্রাণে ম–ম করছে রান্নাঘরের আশপাশ। আম্মা এক টুকরা মাংস তুলে আমাকে দিতেন, ‘দেখ তো সেদ্ধ হয়েছে কি না।’ সেই প্রথম টুকরাটা ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করতে করতে মুখে দিতাম, খানিকটা জিব পুড়িয়ে যে স্বাদ পেতাম, তার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো খাবারের স্বাদেরই তুলনা হয় না।
ওই সময় ওই আধা রান্না মাংস তুলে নিয়ে আমি লোহার শিকে গাঁথতাম। তারপরও সর্ষের তেল ছিটিয়ে দিয়ে কাঠের চুলার আগুনে ধরতাম। পোড়া গন্ধ বেরোত। হয়ে গেল আমার শিককাবাব। কাঁচা পেঁয়াজ কেটে নিয়ে সেটা আমি একলাই খেতাম।
২.
আমাদের শৈশবে ঈদের আরেকটা বিনোদন ছিল সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। প্রচণ্ড ভিড় হতো। ওই সময় সৈনিকদের জন্য আলাদা কাউন্টার ছিল। আমি সেই কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কোনো সৈনিক আংকেল টিকিট কাটতে এলে আমি তাঁকে অনুরোধ করতাম, আমাকে একটা টিকিট কেটে দেবেন? আমার চেহারার মধ্যে একটা বেচারি ভাব তখনো ছিল। সহজেই তাঁরা রাজি হতেন। আমি নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ঈদের সিনেমা দেখতাম রংপুরের লক্ষ্মী টকিজে বা ওরিয়েন্টাল প্রেক্ষাগৃহে। আগের দুদিন মাইকিং করে সিনেমার গান আর নাম জানিয়ে যাওয়া হতো। কাজেই সিনেমা না দেখে পারা যায়?
আরেকটু বড় হলে, ১৯৭৮ সালের পর, ১৯৭৯ সালের দিকে রংপুর টিভি স্টেশন পুরোপুরি চালু হয়ে গেল। রংপুরে সাদা-কালো টিভি এল। আমাদের ঈদের প্রধান বিনোদন ছিল ঈদের নাটক এবং আনন্দমেলা। হুমায়ূন আহমেদের নাটক মানে এক অপরূপ ব্যাপার। আনন্দমেলাও খুব জমজমাট হতো। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, জুয়েল আইচ, আফজাল হোসেন, হানিফ সংকেত একেক ঈদে আনন্দমেলা উপস্থাপন করতেন। উফ্। কী যে হাঁ করে গিলতাম ঈদের সময় টিভি অনুষ্ঠানগুলো।
৩.
ঈদে বাড়ি যাওয়া ছিল আরেকটা আনন্দ আর কষ্টের ব্যাপার। নানা যানজট পেরিয়ে ঝক্কিঝামেলা শেষে ৬ ঘণ্টার পথ ১৮ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে রংপুরে সব ভাইবোন আমরা সমবেত হতাম। আমাদের বাচ্চাকাচ্চারাও একত্র হতো। বাচ্চারা ঈদের সন্ধ্যায় আবার নিজেরাই আনন্দমেলা নামের একটা অনুষ্ঠান করত। আমরা বড়রা তাদের কথামতো নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। একটু পরে সবাই সিরিয়াস হয়ে যেত। প্রতিযোগিতায় জিততেই হবে। পুরস্কার পেতেই হবে। হাস্যকর পুরস্কার। সাবানদানি, কিংবা গমের শিষে আঁকা রবীন্দ্রনাথ। সেটা জয়লাভ করার জন্য বয়স্করা যা করত, সেসব মনে করে আমরা এখনো প্রাণখুলে হাসাহাসি করি।
৪.
এখন তো ঢাকায় ঈদ করি। রংপুরে যাওয়াই হয় না। সব ভাইবোন আর আম্মাও ঢাকাতেই।
ঢাকা নিয়ে একটু ভাবি।
ঢাকা একসময় খুব সুন্দর একটা শহর ছিল। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে পড়েছি, তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এখান থেকে ওখানে নিয়ে গেছেন, অস্ত্রশস্ত্র সরিয়েছেন। আমার লেখা ‘মা’ উপন্যাসের আজাদের ছোট মা আমাকে বলেছিলেন, তিনি গাড়ি চালিয়ে আজাদকে নিয়ে গিয়েছিলেন গুলিস্তান, সেখানে লংপ্লে রেকর্ড পাওয়া যেত, আজাদকে এলভিস প্রিসলির রেকর্ড তিনি কিনে দিতেন।
আমি সেই শহরটার কথা কল্পনা করি। ষাটের দশকের ঢাকা। ধানমন্ডিতে কেবল বাড়িঘর উঠছে। এক বিঘা করে একেকটা প্লট। একতলা বাড়ি, দোতলা বাড়ি। সামনে বাগান। ধানমন্ডিতে ধানখেতও ছিল।
বুদ্ধদেব বসুর ‘আমার যৌবন’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় ঢাকার অপরূপ বর্ণনা পাই:
‘ভেতরে বাইরে জমকালো এক ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরো-কুড়িটা অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ-বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস: আছে ব্যায়ামাগার ও ক্রীড়াঙ্গন ও জলক্রীড়ার জন্য পুষ্কুরিণী—যেখানে-সেখানে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ। ইংল্যান্ড-দেশীয় পল্লি-নিবাসের মতো ঢালু ছাদের এক-একটি দোতলা বাড়ি—নয়নহরণ, বাগানসম্পন্ন: সেখানে কর্মস্থলের অতি সন্নিকটে বাস করেন আমাদের প্রধান অধ্যাপকেরা: অন্যদের জন্যেও নীলক্ষেতে ব্যবস্থা অতি সুন্দর। স্থাপত্যে কোনো একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়া দিল্লির জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি। বিজ্ঞান ভবনগুলো আরক্তিম ও তুর্কি শৈলীতে জাফরি খচিত, মিনার শোভন…
অচিরসমাপ্ত একটি পথ—একদিকে খানপাঁচ-সাত অধ্যাপক নিবাস, অন্যদিকে আদৃষ্টিসীমা প্রান্তর—শূন্য জমি, ঘাসের জমি, ধানখেত হয়তো, আর দূরে একখানা মস্ত গোল অবাধ আকাশ মাটির বুকে লুটিয়ে পড়েছে। বাড়িগুলো একতলা ও অনুচ্চ বলে ভূদৃশ্য ব্যাহত হয়নি; আর এই প্রাকৃত শোভাকে সুন্দরতর করে তীব্র একটা বাঁক নিয়ে চলে গেছে মৈমনসিংহের দিকে রেললাইন।’
আমি ঢাকায় প্রথম আসি ১৯৭৮ সালে। আর পড়তে আসি ১৯৮৪ সালে। তখনো ধানমন্ডিতে দেয়ালঘেরা দোতলা বাড়িগুলো ছিল। পান্থপথ হয়নি। পরিবাগের খালটা তখনো ঢাকা হয়নি। ১৯৯৪ সালে লেখা আমার একটা কবিতায় দেখতে পাচ্ছি, লিখেছি: সত্তর লাখ লোকের শহর ঢাকা।
এখন ঢাকার লোকসংখ্যা কত?
যে বাড়িতে আগে একটা পরিবার থাকত, সেখানে এখন থাকে চল্লিশ পরিবার। কোনো বাড়ির সামনে জায়গা নেই, বাগান নেই। বৃষ্টির পানি চুইয়ে যাবে, এমন কোনো খোলা জায়গা নেই।
এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে।
আমরা যখন ছোট ছিলাম, রংপুরে থাকতাম, তখন আমাদের পরিবারে একটা গরুর তিনটা ভাগ নেওয়া হতো, কোরবানির ঈদে। রংপুর শহরে তখন খোলা মাঠ ছিল এবং ধানখেত ছিল।
কিন্তু কোটি মানুষের ছোট্ট শহর ঢাকায় আমরা অনেকেই ঈদে কোরবানি দিই। আমি নিজে একবার দুটো গরু কিনেছিলাম। কিন্তু পশু যে জবাই করা হবে, তার জায়গাটা কই। প্রথম দিকে ফ্ল্যাটওয়ালারা দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে জায়গা ছাড়তেন। পরে এক ইঞ্চি জায়গাও অপচয় না করাটাই হয়ে গেল দস্তুর। এখন প্রতিটা পাড়ায় প্রতিটা মহল্লায় রাস্তায় রাস্তায় আমরা গরু-ছাগল জবাই করছি, ভুঁড়ি পরিষ্কার করছি, মাংস-হাড্ডি কাটছি।
পৃথিবীর আর কোনো শহরে এ রকম হয় বলে আমি শুনিনি। আমি একবার আমেরিকার আইওয়াতে ছিলাম, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দেশের লেখকদের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে ফিলিস্তিন, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, তুরস্ক, ইরান, ইরাক, নাইজেরিয়া নানা মুসলিমপ্রধান দেশের লেখকেরা ছিলেন। তাঁদের সবাইকে বললাম, তোমাদের দেশে কি কোরবানির ঈদে রাস্তায় রাস্তায় পশু জবাই করা হয়। উত্তর পেলাম: না। কোরবানি দেওয়া হয় নির্ধারিত জায়গায়, সেটা মানুষের বসতি থেকে দূরে। ঢাকা শহরের মতো রাস্তায় রাস্তায় কোরবানি আর কোনো দেশের আর কোনো শহরে দেওয়া হয় বলে কেউ জানালেন না। আমার জানা ভুল হতে পারে। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় কোরবানি ঈদের দিন যে দৃশ্য দেখা যায়, সম্ভবত আর কোনো শহরে এটা দেখা যায় না।
বাংলাদেশের অভিনেত্রী মডেল ফারিহা শামস সেওতি থাকেন কুয়েত সিটিতে। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কুয়েত সিটিতে কি রাস্তায় কোরবানি হয়? তিনি বললেন, না। তিনি কোনো দিনও এটা দেখেননি। তাঁরা যখন কোরবানি দিয়েছেন, শহরের বাইরে দূরে মরুভূমির মধ্যে স্লটার হাউস আছে, সেখানে দিয়েছেন। সকাল সকাল তাঁর বর শাহেদ যেতেন কোরবানির স্থানে। অনেক পরে মাংস নিয়ে আসতেন। সময় লাগত। কুয়েত শহরের মধ্যে কোরবানি দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই।
আমি গত কোরবানির ঈদে ছিলাম বোস্টনে। সেখানেও একই নিয়ম। কোরবানি করতে হলে আগে থেকে স্লটার হাউসকে বলে রাখতে হয়। তারা কোরবানি করে মাংস প্রস্তুত করে একবারে দিয়ে দেয়।
ফেসবুকে আমি জানতে চেয়েছিলাম, কোনো প্রবাসী বন্ধু কি জানাবেন অন্যান্য দেশে কী করা হয়?
আরব আমিরাত থেকে একজন লিখেছেন, ওই দেশে রাস্তায় পশু কোরবানি করলে ১০ হাজার দিরহাম জরিমানা। রাস্তায় কোরবানি করার প্রশ্নই আসে না।
আরেকজন আরব আমিরাত থেকে লিখেছেন, শহরের বাইরে কোরবানির হাট আছে। তার পাশেই আছে জবাইখানা। নিজের বাড়িতেও কোরবানি করা যাবে না।
সৌদি আরব থেকে এক ভাই লিখেছেন, ওই দেশে রাস্তায় কোরবানি দিলে ২০ হাজার রিয়াল জরিমানা। মালয়েশিয়া থেকে একজন লিখেছেন, বাড়ির বাইরে কোরবানি দেওয়া হয় না। সব বর্জ্য প্যাকেট করে ডাস্টবিনে রেখে আসতে হয়। সিঙ্গাপুর থেকে একজন লিখেছেন, সিঙ্গাপুরে মসজিদের বেসমেন্টে কোরবানির জন্য জায়গা করা আছে। সবাই সেখানেই কোরবানি দেন।
আমার ছোটবেলায় কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আমি এই রকম নিয়মই দেখেছি। ঈদের নামাজের পর একটা মাঠে গরু ছাগল কোরবানি দিয়ে মাংস প্রস্তুত করে বাড়িতে আনা হতো।
বলছিলাম, বাংলাদেশের মানুষদের আয় বাড়ছে। সামর্থ্য বাড়ছে। এখন আমরা অনেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কোরবানি দিয়ে থাকি। ঢাকা শহরে যে একটা ফাঁকা জায়গা নেই। রাস্তা ছাড়া যে আমাদের কোনো উপায় নেই। এখন আমাদের করণীয় কী!
সিটি করপোরেশন একবার একটা ঘোষণা দিয়েছিল। কোনো কোনো এলাকাকে কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, কিন্তু কেউ সে কথা শোনেনি। সবাই নিজ নিজ বাড়ির সামনেই কোরবানি দিয়েছেন।
আমাদের দেশে মানুষ বেশি। জায়গা কম। আরব আমিরাতের মতো আমাদের তো প্রচুর জায়গা পতিত নেই। আমরা কী করতে পারি?
এই মুহূর্তে আমার মাথায় কোনো আইডিয়া আসছে না। তবে আমরা যেহেতু মধ্য আয়ের দেশ হয়ে গেছি, আমাদের তো আরেকটু পরিচ্ছন্ন হতেই হবে, আরেকটু নাগরিক ভব্যতা অর্জন করতে হবে। আমাদেরও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। হয়তো প্রাইভেট কোম্পানি দাঁড়িয়ে যাবে, যারা আমাদের হয়ে গরু-ছাগল কেনা থেকে শুরু করে গরু-ছাগল প্রসেস করা, সব করে দেবে, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে, স্বয়ংক্রিয় মেশিনে, আবার ধর্মীয় নিয়মকানুন মান্য করে।
তবে আমার ধারণা, আজ থেকে ২০ বছর পর আমরা আর কেউ ঢাকার রাস্তায় উন্মুক্তভাবে কোরবানি দেব না। খুব সুন্দর বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে। আমরা নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কোরবানি দেব, মাংস প্রসেস করব। সেটা হয়তো আগামী বছরে হবে না, দুই চার বছরেও হবে না। কিন্তু নিশ্চয়ই খুব সৃজনশীল একটা বুদ্ধি আমরা ঠিকই বের করে ফেলব।
৫.
এবার ঈদ এখন পর্যন্ত ভালোভাবেই যাচ্ছে। প্রথম আলো অনলাইনে কোনো খারাপ খবর এখনো দেখিনি। ছাগলের নাম সালমান খান আর ওবায়দুল কাদেরের উক্তি: জ্বালাও–পোড়াও করলে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে—এগুলো ঠিক দুঃসংবাদ নয়। গতকালের কাগজে সড়ক দুর্ঘটনার খবর অবশ্য ছিল।
যে যেখানে যেভাবে ঈদ করছেন, নিরাপদে করুন। নিরাপদে থাকুন। সুন্দরভাবে সবাই কর্মস্থলে বা গন্তব্যে ফিরে আসুন। সবার ঈদ ভালো কাটুক।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment