একটি মাত্র ভাষা জানা যথেষ্ট নয়
সংবাদ বাংলা: বিশ্বায়নের এই যুগে, শ্রম বাজারে টিকে থাকতে হলে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। জানতে হবে একাধিক ভাষা। বাইরের দেশে লেখাপড়া, কাজ এবং স্থায়ীভাবে বাস করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হল সেই দেশের ভাষা জানা থাকা। আপনি যে দেশেই যান না কেন আপনার সে দেশের ভাষাজ্ঞান নিয়েই তবে সে দেশে লেখাপড়া, কাজ এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাবেন। ইউরোপের দেশগুলোর স্কুলে মাতৃভাষা ছাড়া দ্বিতীয় একটি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক। আমেরিকার প্রাথমিক শিক্ষায়ও এমনটি রয়েছে। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে সবার প্রথমেই আসে ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার পাশাপাশি অনেকেই ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়ে জার্মান, স্প্যানিশ, চীনা, জাপানী, কোরিয়ান, ফরাসি, আরবিতে নিজেকে পারদর্শী করে তুলছেন। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাতে আপনি দক্ষ হবেন এটিই স্বাভাবিক। আগে একটা সময় ছিল ইংরেজি জানা থাকলে ভালো চাকরি পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজির পাশাপাশি আরও দুই একটি বিদেশি ভাষা জানা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আপনি ইংরেজি ছাড়া অন্য একটি ভাষা বেশি জানেন, এর মানে আপনি এগিয়ে আছেন অন্য অনেকের চেয়েই।
ইংরেজি ভাষা: মানুষের দৈনন্দিন কাজে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার এবং প্রয়োগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির কদর বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার সনদ হিসেবে আইইএলটিএস স্কোরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম বা আইইএলটিএস সারা পৃথিবীতে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা পরীক্ষার একটি আন্তর্জাতিক মাপকাঠি। আইইএলটিএস দু ধরনের হয়ে থাকে একাডেমিক ও জেনারেল ট্রেনিং মডিউল। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পড়তে চাইলে একাডেমিক মডিউল আর ইমিগ্রেশন বা কাজের জন্য জেনারেল ট্রেনিং মডিউলে অংশ নিতে হয়। আইইএলটিএস পরীক্ষায় দুই ধরনের মডিউলেই চারটি অংশ থাকে। লিসেনিং, রিডিং, রাইটিং ও স্পিকিং। অন্যদিকে টোফেল এমন একটি পরীক্ষা যার মাধ্যমে আপনি ইংরেজিতে কতটুকু দক্ষ, তা যাচাই করা হয়। টেস্ট অব ইংলিশ অ্যাজ এ ফরেন ল্যাংগুয়েজ (টোফেল)। এ পরীক্ষার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, বিশ্বের প্রায় ১৩০টি দেশের দশ হাজারেরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টোফেল স্কোরকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। কোনো শিক্ষার্থী যদি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চান, তবে তাকে অবশ্যই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা দিতে হবে।
আরবি ভাষা: এদেশের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিটেন্স আসে সৌদি আরবসহ আরবি ভাষা-ভাষি দেশগুলো হতে। প্রতিবছর বাংলাদেশ হতে অসংখ্য জনগোষ্ঠী আরব দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু তারা পেশাগতভাবে আরবি ভাষায় দক্ষ না হওয়ায় যথার্থ বেতন-ভাতা ও নানাবিধ সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বের আলজেরিয়া, বাহরাইন, চাঁদ, কমোরোস, জিবুতি, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইরাক, ইসরাইল, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনিশিয়া, সংয়ুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় ভাষা। এসব আরব দেশ ছাড়াও তুরস্ক, মালয়েশিয়া, সেনেগালসহ ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ ভাষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ওআইসিসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসিয়াল ভাষা হলো এই আরবি। শুধু তা-ই নয়; ‘ট্রেড ল্যাংগুয়েজ’ হিসেবে এ ভাষা অনারব দেশেরও প্রায় প্রতিটি পণ্যের মোড়কে শোভা পায়। এতে করে আরবি ভাষায় দক্ষতা ক্যারিয়ার গড়তে আপনাকে দেবে বাড়তি সুবিধা।
ফরাসি ভাষা: এই ভাষার মূল প্রচলন ইউরোপ মহাদেশে। বিশেষত ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও পার্শ্ববর্তী কিছু দেশে। চীনা, ইংরেজি, হিন্দি, স্প্যানিশ এবং আরবি ভাষার পর ফরাসি ভাষা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটি লোক মাতৃভাষা কিংবা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ফরাসিতে কথা বলেন। বিশ্বের প্রায় ৫৪টি দেশে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বর্তমান যুগে ফরাসি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে তরুণ সমাজের মধ্যে বেশ ঝোক দেখা যায়। অন্যান্য ভাষাগুলোর তুলনায় ফরাসী ভাষা শেখা তুলনামূলক মজার।
স্প্যানিশ ভাষা: বর্তমান পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৬ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৪০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা হলো স্প্যানিশ। শুধু তাই নয়, স্প্যানিশ পৃথিবীর ২১টি দেশের মানুষের প্রধান ভাষা। মেক্সিকো স্প্যানিশভাষীর সংখ্যায় বৃহত্তম দেশ। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই বহুল ব্যবহৃত ভাষা হলো স্প্যানিশ। এটি ইউরোপ ছাড়াও, ব্রাজিল, স্পেন এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় ভাষা। বর্তমান চাকরির বাজারে ভিন্ন এক বা একাধিক ভাষায় পারদর্শিতা অন্য দশজন প্রতিযোগীর চেয়ে একধাপ এগিয়ে রাখবে। কর্মক্ষেত্রে স্প্যানিশ ভাষা জানা মানুষের গুরুত্ব অনেক, কেননা স্প্যানিশ ভাষাভাষী দেশগুলোই বর্তমানে ব্যবসায় রাজত্ব করছে। এছাড়া রয়েছে উচ্চশিক্ষার সুযোগ। আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে স্প্যানিশ ভাষা জানা মানুষদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
কোরিয়ান ভাষা: ইদানীং রাস্তার পাশে দেয়ালে সাঁটা পোষ্টারে হরহামেশাই দেখা যায় ‘কোরিয়ান ভাষা শিখুন’ এমন বিজ্ঞাপন। সরকারিভাবেও ইদানিং বিদেশি ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে এই ভাষাটিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেশের প্রায় সকল জেলায় সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এই ভাষা শেখানো হচ্ছে। এর বাইরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি কোরিয়ান ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র। কোরিয়ায় চাকরীর একটি বড় বাজার সৃষ্টি হয়েছে। তাই কোরিয়ান ভাষা শেখার আগ্র বাড়ছে দিনদিন।
জাপানি ভাষা: জাপানের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক দীর্ঘদিনের। উন্নত এই দেশটির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য সব ধরনের যোগাযোগের সহজ মাধ্যম জাপানি ভাষা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া সুযোগ পেতে জাপানি ভাষায় পারদর্শীতা প্রয়োজন পড়ে।
চীনা ভাষা: একথা অনস্বীকার্য যে গত কয়েক দশকের মধ্যে চীন সারা পৃথিবীর ব্যবসায়িক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যেরও বড় একটা অংশ দখল করে আছে চীনের পণ্য এবং দিনদিন বড় হচ্ছে তার পরিধি। তাই এদেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে চীন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। চীনের কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের আমাদের দেশের এসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ে চীনা ভাষায় দক্ষ লোকের। চীনে স্কলারশীপে পড়াশোনা করার ব্যপক সুযোগ রয়েছে।
কোথায় শিখবো?
ব্রিটিশ কাউন্সিল: এটি যুক্তরাজ্য থেকে পরিচালনা করা হয়। ইংরেজি ভাষার ওপর কোর্স করার জন্যে সেরা এই ব্রিটিশ কাউন্সিল। বিভিন্ন মেয়াদের কোর্স এখান থেকে করতে পারবেন।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ১৫টি ভাষার ওপর কোর্স করানো হয়। ভাষাগুলি হচ্ছে ফরাসি, জার্মান, জাপানি, আরবি, রুশ, ফারসি, ইংরেজি, কোরিয়ান, চীনা, স্প্যানিশ, তুর্কি, পর্তুগিজ, ইটালিয়ান, উর্দু, হিন্দি। কোর্সগুলি স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদী। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে কোর্স করতে পারে। বাইরের শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট ফি দিয়ে কোর্স করতে পারেন। তাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক যেকোনো একটিতে কমপক্ষে বি গ্রেড পেতে হবে।
জাপান স্টাডিজ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত জাপান স্টাডিজ সেন্টারে ২ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা করানো হয়।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: উচ্চ মাধ্যমিক পাসকৃত যে কেউই এখানে ভর্তি হতে পারবেন।
গোয়েথে ইনস্টিটিউট: জার্মান শিখার জন্যে জনপ্রিয় হচ্ছে গোয়েথে ইনস্টিটিউট। এটি সরাসরি জার্মান দূতাবাস থেকে পরিচালনা করা হয়।
ডী স্প্রাখে: চট্টগ্রামে জার্মান ভাষা শিখার ব্যক্তিগত ইনস্টিটিউট। আপনি এখান থেকে বিশ্বমানের জার্মান কোর্স সম্পন্ন করতে পারবেন। সন্ধ্যাকালীন এবং সাপ্তাহিক দিনে এই দুই ধরনের কোর্স এখানে চালু রয়েছে।
আলিয়ঁস ফ্রঁসেস: ফরাসি ভাষা শেখার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আলিয়ঁস ফ্রঁসেস অন্যতম। ফ্রান্সের দূতাবাস এটি পরিচালনা করে। কোর্সের মেয়াদ এক বছর।
ভাষা শেখার ৫ কৌশল
ভয় দূর করুন: আপনি ভুলভাল বলে বসবেন, আটকে যাবেন। আশেপাশের সবাই আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। কে হাসলো বা কি করলো, ওইসব ভুলে যান। আপনি যদি শুরুই না করেন, আপনি কখনোই বুঝতে পারবেন না আপনার কোথায় ভুল হচ্ছে, কোন জায়গায় আপনাকে উন্নতি করতে হবে। কাজেই অহেতুক ভয় অথবা লজ্জা দূর করুন।
যে ভাষা শিখেছেন সে ভাষায় ভাবতে শিখুন: আমরা যখন কথা বলি, আমাদের মাথার ভিতরে আগে কথাগুলো সাজাই। তারপরেই বলা শুরু করি। এখন আপনি যদি ইংরেজি বলতে গিয়ে বাংলাতেই কথা সাজানো শুরু করেন অথবা ভাবা শুরু করেন, আপনি ভালোভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারবেন না। এজন্য কথা শুরু করার আগে চিন্তা করতে শিখুন। ভাবতে শিখুন।
শব্দভাণ্ডার বাড়ান: প্রতিদিনই চেষ্টা করুন নতুন নতুন কিছু শব্দ শিখতে। সহজ শব্দগুলোই শিখুন, যেগুলো আপনি কথা বলার সময় ব্যবহার করতে পারবেন।
মিডিয়া কাজে লাগান: কথা বলার ক্ষেত্রে আপনি বিভিন্ন মিডিয়া অথবা মাধ্যমের সাহায্য নিতে পারেন। ইংরেজি বই, ইংরেজি পত্রিকা পড়ুন। কোরিয়ান কিংবা ফরাসি অনেক মুভি আছে সেগুলো দেখতে পারেন।
বন্ধু খুঁজে নিন: ৫/৬ জন বন্ধু মিলে প্রতিদিন কথা বললে আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন না যে কত দ্রুত আপনি বিদেশি ভাষায় দক্ষভাবে কথা বলতে শিখে গেছেন। নিজের ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যান। জয়ী আপনি হবেনই।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment