একাত্তরে ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের বিজ্ঞাপন
সংবাদ বাংলা: ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে ডন পত্রিকায় ধর্মের দোহাই দিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ও অর্থ দানের আহ্বান জানিয়ে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। একাত্তরে নির্বিচারে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী নিধন, লাখ লাখ নারী ধর্ষণের বিষয় আড়ালে রেখে ধর্মের দোহাই দিয়ে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে নেমেছিল পাকিস্তান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের দ্বারপ্রান্তে যখন বাংলাদেশ, তখন মরণকামড় দিতে মরিয়া পাকিস্তান নিজ দেশে জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহে পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে সেসব বিজ্ঞাপন দেয় বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক। প্রায় প্রতিটি বিজ্ঞাপনে মুক্তিযুদ্ধকে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ উল্লেখ করে ধর্মকে টেনে আনা হয়। প্রত্যেক শ্রেণির মানুষকে তাদের সম্পদের কমপক্ষে ১০ শতাংশ দান করার আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপনগুলোতে বলা হয়, বেশি দান করলে আল্লাহ পুরস্কার দেবেন। অতীতের ধর্মীয় যুদ্ধে ইসলামের খলিফাদের সম্পদ দানের উদাহরণও টানা হয় ওই সব বিজ্ঞাপনে। পাকিস্তানের খ্যাতনামা ইংরেজি পত্রিকা ডন ডটকমের আর্কাইভ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
১৯৭১ সালের ১৪ থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডন পত্রিকায় এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রচার করা হয়। পাকিস্তানের পরাজয়ের দিনকে সামনে রেখে ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর ডন ডটকম আর্কাইভে সংরক্ষিত এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রকাশ করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাতে আরও তথ্য যুক্ত করে হালনাগাদ করা হয়। এটাকে ‘অন্ধকার সময়’ উল্লেখ করে ডন ডটকমে বলা হয়, সংবাদপত্রে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে উঠে এসেছে অতীতের অন্ধকার সময়ের এক ঝলক। কিছু বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি রুপি দান করার বিষয়টি উল্লেখ করা ছিল। তবে এসব বিজ্ঞাপন স্বেচ্ছায় নাকি, পাকিস্তানি শাসক বাধ্য করেছিল, তা যাচাই করা যায়নি। এসব ইংরেজি বিজ্ঞাপনের বাইরে উর্দু ভাষায় অন্যান্য স্থানীয় পত্রিকায় এ ধরনের কত বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছিল, সে তথ্যও নিশ্চিত করা যায়নি।
ডন ডটকম প্রচারিত বিজ্ঞাপন-সংক্রান্ত এ তথ্যের নিচে শত শত পাঠক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এতে কেউ কেউ পাকিস্তানের অখণ্ডতা না থাকায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। যুদ্ধে ধর্মের দোহাই দেওয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ আবেগ প্রকাশ করেছেন, কেউ নিন্দা জানিয়েছেন। অনেকে ওই সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যার বিষয়টি তুলে এনেছেন। পাঠক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও যুদ্ধের সময়কার প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন অনেকে।
১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে ডন পত্রিকায় ধর্মযুদ্ধে ইসলামের খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এবং হজরত উমর (রা.)-এর সম্পদ দান করার বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে জনগণকে তাদের সম্পদের কমপক্ষে ১০ শতাংশ দান করার আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।
বিজ্ঞাপনে যুদ্ধের সপক্ষে ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবহার
জিহাদ শিরোনামে হাবিব ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘যখন মুসলিমরা জিহাদ পরিস্থিতিতে থাকেন, তখন সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশের সময় হয়ে যায়। আসুন, আমরা প্রত্যেকে সেই কাজ করি…। হাবিব ব্যাংক জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলে ২ কোটি ৪৬ লাখ রুপি দিয়েছে। হাবিব ব্যাংকের কর্মীরা শুধু তাদের বেতন থেকেই অর্থ দেননি, বরং তারা বাইরে থেকেও তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে। হাবিব ব্যাংকের সব শাখায় দান নেওয়া হচ্ছে।’
সাবান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডারবার সোপ ওয়ার্কস লিমিটেডের বিজ্ঞাপনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য প্রচার করে বলা হয়, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর অঙ্গীকার স্মরণ করুন যে ন্যায়বিচারের পথে আপনি যদি অটল হন, তবে আল্লাহ আপনাকে চূড়ান্ত বিজয় দান করবেন। আল্লাহ আকবর বলে এগিয়ে যান, শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’
পাকট্র্যাক (করাচি, লাহোর ও ঢাকা) ব্যানারে প্রচারিত আরেকটি বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমন, শত্রুকে পুরো ধ্বংস করুন। জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলে মুজাহিদের মতো দান করুন।
রিজভি ব্রাদার্স লিমিটেডের আরেকটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ইসলামের ঐতিহ্য অনুসারে সত্যিকারের যোদ্ধার মতো আমাদের নির্ভীক সেনারা পাকিস্তানের পবিত্র ভূমি রক্ষার জন্য লড়াই করছে। একই প্রতিষ্ঠানের পৃথক বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘আমাদের সাহসী যোদ্ধারা শত্রুকে নির্মূল করছে, পুরো জাতি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে পর্বতের মতো। সর্বশক্তিমান আল্লাহর সহায়তায় কাপুরুষ শত্রুকে চূর্ণ করে আমরা পরাজিত করব ইনশা আল্লাহ।’
ধর্মের দোহাই দিয়ে এক বিজ্ঞাপনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে অর্থ চেয়ে আবেদন জানানো হয়। ‘প্রত্যেক পাকিস্তানির কাছে আবেদন’ শিরোনামের ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘নবীজির সময়ে যখন জিহাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হয়, তখন হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর সবকিছুই দান করে দেন এবং হজরত উমর (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক দান করেন। আজ আমরা ধনী, গরিব, ব্যবসায়ী, ভূস্বামী প্রত্যেক পাকিস্তানির কাছে আবেদন জানাচ্ছি, তারা যেন তাদের সম্পদের কমপক্ষে ১০ শতাংশ দান করেন। যাঁরা বেশি দান করবেন, তাঁরা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। আজ আমাদের নির্ভীক সেনারা আমাদের সুরক্ষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য জীবন দান করছেন। সৈনিকদের হাতকে শক্তিশালী করতে আমরা অবশ্যই দান করব এবং উদারভাবে দান করব প্রতিরক্ষা তহবিলে।’
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ছবি ও যুদ্ধরত সৈনিকদের ছবি ব্যবহার করে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক বিজ্ঞাপন প্রচারে। ওই বিজ্ঞাপনে ইয়াহিয়ার বাণী প্রচার করে বলা হয়, ‘দিন ও রাতের প্রত্যেক সময়ে, আপনার অবশ্যই নিজেকে একটি প্রশ্ন করা উচিত: জাতীয় যুদ্ধে আমি কী অবদান রাখছি?’ তহবিলে অর্থ দান করার আবেদন জানিয়ে ইউনাইটেড ব্যাংক বিজ্ঞাপনে জানায়, তারা ১ কোটি ৩২ লাখ রুপি দান করেছে। বিজ্ঞাপনটির ভাষা ছিল এমন, ‘এই যুদ্ধে আমাদের প্রত্যেকের অংশ নেওয়া দায়িত্ব। আমাদের গাজিরা মাতৃভূমিকে রক্ষা করছে, তাদের সফলতার জন্য আমাদের অবদান রাখতে হবে।’
তহবিলে অর্থ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ছিল ‘সিলভার বুলেট’। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কায়েদ-ই-আজম (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদ-ই-আজম বলা হয়) বলেছিলেন, ‘আমাকে সিলভার বুলেট দাও এবং আমি তোমাদের পাকিস্তান দেব।’ পবিত্র ভূমির সম্মান ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য রুপালি বুলেটের আবারও প্রয়োজন আজ। একই ব্যাংকের আরেক বিজ্ঞাপনে কায়েদ-ই-আজমের বাণী তুলে ধরা হয়, ‘মুসলিমরা কখনো ধ্বংস হতে পারেন না। গত এক হাজার বছরেও কোনো শক্তি তাদের ধ্বংস করতে পারেনি। এটা স্বপ্ন ও অলীক ভাবনা। ঝেড়ে ফেলুন তা…আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের ইসলামি আদর্শ আমাদের পরিচালনাকারী শক্তি…।’
করাচির এক পোশাক বিক্রির প্রতিষ্ঠান আফতাব শফিক ওমর শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্স পোশাক কেনার মাধ্যমে তহবিলে অর্থ দান করে নারীদেরও জিহাদের অংশ হওয়ার আবেদন জানিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে।
পাঠক প্রতিক্রিয়া
ডন ডটকমের প্রকাশিত এ তথ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ডা. আবদুল মান্নান নামের একজন মন্তব্য করেছেন, ‘জিহাদ শব্দটিকে দয়া করে খাটো করবেন না। জিহাদ নামে ডাকা না হলেও যখনই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আহ্বান জানাবে আমরা অবশ্যই সাড়া দেব। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি।’
সাইফ নামে অপর এক পাঠক দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘ওটা ছিল একটি অন্ধকার সময়। কারণ, ভারত আমাদের আক্রমণ করেছিল। যুদ্ধের সময় কোনো একজনকে লোকজনকে একত্র করার উদ্যোগ নিতে হয়। আর এই বিজ্ঞাপনগুলো ছিল তাই।’
ওয়াসিম নামে এক পাঠক প্রতিক্রিয়া জানান এই বলে, ‘একাত্তর সালে বাংলাদেশের গণহত্যাকে আপনারা “জিহাদ” ভাবছেন? সত্যি! পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৭১-এ বাংলাদেশে কী করেছিল, তা না জেনে যদি এখনো আত্মতৃপ্তি পেয়ে থাকেন, তাহলে দয়া করে গুগল করুন, আপনারা অনেক কিছু খুঁজে পাবেন! এর মুখোমুখি হন, এই বিভক্তির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দায়ী। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যদি তারা গণহত্যা শুরু না করত, তাহলে এখনো এটা এক দেশই থাকত।’ বিনয়ী নামে এক পাঠক মন্তব্য করেছেন, ধর্ম হওয়া উচিত একদম ব্যক্তিগত। দেশ শাসনে ধর্মকে কখনো মেশানো ঠিক না। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই তা করা হয়েছে। রিজওয়ান নামের একজন বিজ্ঞাপনগুলো প্রকাশের জন্য ডনকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এ থেকে আমাদের সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত।’
জেফ লিখেছেন, ‘ঢাকা পরাজয় থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। বালুচ ও সিন্ধুতে একই কাজ করছি।’
রাজ লিখেছেন, আজ পাকিস্তান টিটিপি জঙ্গিদের কাছ থেকে জিহাদের অভিজ্ঞতা লাভ করছে, তাই নয় কি?
রিজওয়ান লিখেছেন, ‘আমাদের জাতীয় অখণ্ডতার বিষয়ে দিনটি কষ্টের। অবাক লাগে, কেন বাঙালি ভাইয়েরা আলাদা হতে চেয়েছিল।’
উমর ফারুক লিখেছেন, এই যুদ্ধে ভারত লাফিয়ে পড়েছিল। এটা ছিল জিহাদ।
উসমান খালিদ লিখেছেন, ‘সত্যের মুখোমুখি হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়। ইয়াহিয়া আর ভুট্টো তা দিতে অস্বীকৃতি করায় এটা ঘটে। আমাদের বাহিনী নির্যাতন করেছিল বাংলাদেশে।’
আশিস লিখেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে গণহত্যা চালিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সাধারণ লোকজন ছিল সে ব্যাপারে অন্ধ।
ওমর রানা প্রচারিত বিজ্ঞাপনকে লিখেছেন, সস্তা প্রচারণা, দুঃখজনক ও অসুস্থ রাজনীতিকদের অসুস্থতা।
মুহাম্মদ সুমার লিখেছেন, ‘তখন এবং এখন আমরা শুধু ধর্মের মধ্যেই আটকে আছি। আমরা পাকিস্তান সৃষ্টি করেছি ধর্মের নামে। আবার পাকিস্তানকে ধ্বংসও করছি ধর্মের নামে।’
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment