এখনো সদর্পে আছেন ইংরেজরা
এম মামুন হোসেন: ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র আট ঘণ্টা। সেই যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী ও ধ্বংসাত্মক। ব্রিটিশদের জন্য বাংলা অনেকটা স্প্রিংয়ের মতো কাজ করে। এরপর সমগ্র ভারতবর্ষ গ্রাস করে দুইশ’ বছর শোষণ করে ইংরেজরা। ১৯৪৭ সালে ভারত ছাড়ার আগে ইংরেজদের ফের কূটচালে রক্তগঙ্গা বহে এই অঞ্চলে। ধর্মের রেখা টেনে ভাইয়ে ভাইয়ে বিভক্তি টানেন জন রেডক্লিফ। ইতিহাসের এমন অনেক কুখ্যাত ও অত্যাচারিত ইংরেজ শাসকরা রয়ে গেছেন ঢাকায়। এখনো সদর্পে আছেন মি. আয়ার, জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলার, ল্যান্সলট হেয়ার, ডা. জেমস ওয়াইজ, মি. ইংলিশ, লর্ড কার্জন, লর্ড মিন্টো।
মিন্টো রোড: লর্ড মিন্টো ১৯০৫ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় ছিলেন। ১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি লর্ড কার্জনের উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত হন। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ছিলেন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রূপকার। বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা রাজধানী হলে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা এলাকা ঘিরে অনেক বড় বড় সরকারি স্থাপনা নির্মিত হয়। স্থাপনাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বর্তমান কার্জন হল, পুরনো হাইকোর্ট ভবন, সেক্রেটারিয়েট ভবন (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবন), ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল), জগন্নাথ হল, গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন)। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের আবাসনের জন্য নির্মিত হয় বেশ কয়েকটি বাংলোঘর, ঢাকা ক্লাব এবং রমনা রেসকোর্স। একইসঙ্গে গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টোর নামে করা হয় মিন্টো রোড। মিন্টো তার শাসনামলে গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরেন। ১৯১০ সালে প্রেস অ্যাক্ট পাস করেন। এ আইনের আওতায় রাষ্ট্রবিরোধী কোনো প্রকাশনার অভিযোগে কঠোর অর্থদণ্ড এবং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ আইনের ফলে সরকারের কোনো রকম স্বাধীন সমালোচনাই করা সম্ভব ছিল না। প্রচণ্ড জনরোষের মুখে ১৯১০ সালের নভেম্বর মাসে মিন্টো পদত্যাগ করে দেশে ফেরেন। সেই মিন্টো রোড হাল আমলে মন্ত্রীপাড়া হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বাসভবনগুলো মিন্টো রোডে।
ফুলার রোড: পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশের প্রথম লে. গভর্নর জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলারের নামানুসারে ফুলার রোডের নামকরণ করা হয়। তিনি শাসক ও প্রজাবৎসল ছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে শ্রেণীটি বিক্ষোভ করেছিল মি. ফুলার তাদের কঠোর হস্তে দমন করেন। লর্ড মিন্টোর সঙ্গে ফুলারের সম্পর্ক ভালো ছিল না। চাপের মুখে পূর্ববঙ্গ ও আসামের গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার পদত্যাগ করেন।
হেয়ার রোড: লর্ড মিন্টোর সঙ্গে নীতিগত বিরোধ দেখা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত মি. ফুলার পদত্যাগ করেন। মি. ফুলারের পর পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশে গভর্নর হয়ে আসেন ল্যান্সলট হেয়ার। ১৮৯৩ সালে তিনি ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তারই নামানুসারে হেয়ার রোডের নাম রাখা হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা পর্যন্ত তিনি এ পদেই অধিষ্ঠিত থাকেন। বর্তমান সরকারি আমলাপাড়া হেয়ার স্ট্রিট ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করে এবং তার নামেই এ এলাকার নামকরণ হয়।
বেইলি রোড: বেইলি রোডের নামকরণ নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। কর্নেল বেইলির নামানুসারে বেইলি রোডের নামকরণ করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। অন্য ধারণাটি এইচ বেইলিকে ঘিরে। ওয়াহাবী আন্দোলন দমনকালে স্পেশাল বেঙ্গল পুলিশের ডিআইজি এইচ বেইলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তার নামানুসারেই বেইলি রোডের নামকরণ হয়েছে। বেইলি রোড আর নাটকের ইতিহাস একটা আরেকটার পরিপূরক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ দেশে মঞ্চনাটকের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এর আগে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক মঞ্চায়ন হলেও বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মিলনায়তনেই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হয়। নাটকপাড়া ঘিরে এখানে সৃজনশীলদের জম্পেস আড্ডার আসরে পরিণত হয়েছিল। যা প্যারিসের ক্যাফেগুলোকে মনে করিয়ে দিত। অন্যদিকে রমজানের প্রতিটি বিকেল বেইলি রোডে বাহারি রঙের ও স্বাদের ইফতারের পসরায় জমজমাট হয়ে ওঠে। উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে বিভিন্ন স্বাদের ইফতারি কিনে রোজাদাররা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন।
ওয়ারি: ১৮৮৪ সালে ঢাকা ম্যাজিস্ট্রেট মি. আয়ারের নামানুসারে অয়্যার স্টিট নামকরণ করা হয়েছে। অনেকেরই ধারণা সম্ভবত অয়্যার শব্দটি বিকৃত হয়ে ওয়ারি হয়েছে। এ ধারণার ঐতিহাসিক কারণ এখনো নির্ণীত হয়নি। ওয়ারি এলাকাটি ব্রিটিশ সরকার একটি অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেন। এ এলাকার জমি পদস্থ সরকারি চাকুরেদের মধ্যেই সাধারণত বণ্টন সীমাবদ্ধ রাখেন। বণ্টনকালে সরকার শর্ত দিয়েছিল, বিঘাপ্রতি ছয় টাকা কর এবং তিন বছরের মধ্যে বাড়ি তৈরি করতে হবে। ওয়ারিতে আছে উদ্ভিদ উদ্যান ‘বলধা গার্ডেন। প্রচুর দুর্লভ গাছপালা বেষ্টিত বলধা গার্ডেনের সূচনা করেন তদানীন্তন ঢাকা জেলা, বর্তমান গাজীপুর জেলার বলধার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী।
ইংলিশ রোড: ব্রিটিশ শাসনামলের কোনো এক সময়ে মি. ইংলিশ (বা ইংলেশ) ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন। তারই নামানুসারে ইংলিশ রোডের নামকরণ হয়েছে। কিন্তু শব্দ বিভ্রাটে অনেকেই মনে করেন এই অঞ্চলে কোনো এক সময়ে ইংরেজদের বসতি ছিল। তাই এই রাস্তার নাম ইংলিশ রোড রাখা হয়েছে। ফ্রেঞ্চ রোডের বেলায়ও অনেকে এরূপ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকেন। তাদের ধারণা ফরাসি বসতি স্থাপনকারীদের স্মরণেই রাস্তাটির নাম ফ্রেঞ্চ রোড রাখা হয়েছে। আসলে ১৯১৮ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন মি. এফ সি ফ্রেঞ্চ। তারই নামানুসারে এ রাস্তার নাম ফ্রেঞ্চ রোড।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment