এবার মুদ্রা যুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প
মোহাম্মদ রেদওয়ান আতিক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্য এবং মূলধন প্রবাহ সীমিত করার জন্য আমদানি শুল্ক এবং অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয় ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা চীনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হতে যাওয়া মুদ্রা ‘রেনমিনবি’র উপর কোন বিধি নিষেধ আরোপ করবে কিনা? সপ্তাহান্তে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশকিছু ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে এবার কী তাহলে বিশ্ববাসী ট্রামের মুদ্রা যুদ্ধ দেখবে। ট্রাম্প প্রশাসন এমন একটি ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করেছে যা চীনের সাথে তার বাণিজ্য ভারসাম্য দূর করে। এরসঙ্গে নিজ্বস্ব শিল্পের সুরক্ষা দেয়; যাতে করে সেগুলোর বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। এতে ষ্পষ্ট যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক শত্রু হিসেবে দেখছে চীনকে।রেনমিনবি এখন ডলারের প্রতিপক্ষ ঘোষণার অপেক্ষা মাত্র।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ঘোষণা আসার পরে ২৫ শতাংশ ইস্পাতের উপর এবং ১০ শতাংশ অ্যালুমনিয়্যামের উপর আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আমদানি শুল্ককে দরকষাকষির একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ট্রাম্প প্রশাসন।
অন্যদিকে চীন কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে ইস্পাত বা অ্যালুমনিয়ামের একমাত্র বা প্রধান সরবরাহকারী নয়; বিশ্বব্যাপী ইস্পাত এবং অ্যালুমনিয়ামের ব্যবসাকে বিস্তৃত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্প আরোপ চীনের ইস্পাত ও অ্যানুমনিয়াম ব্যবসায় বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এর কারণ হচ্ছে চীন উৎপাদন খরচ কমিয়ে স্বল্পমূল্যে বিশ্ববাজারে সরবারাহ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ফলে চীন তার উৎপাদন কমাতে বাধ্য হবে। সেইসঙ্গে পণ্যর মূল্য ও বৃদ্ধি পাবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত ব্যবসায়ীরা বাজার প্রতিযোগীতায় নিজেদের অবস্থান ফিরে পাবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম বাজারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে।
এমনকি আরো নাটকীয়ভাবে, চীনা পণ্যের উপর ৬০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি সংস্থাগুলো বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অধিগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কারণ চীনা প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সংবেদনশীল মার্কিন সেক্টরে বিনিয়োগ করছিল যেমন সেমি কন্ড্রাক্টর এবং ৫জি বেতার যোগাযোগ প্রযুক্তি যা মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কোয়ালকমের। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ব্রডকমের একটি ১১৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। ব্রডকম (এটি সিঙ্গাপুর ভিত্তিক ফার্ম ) যার চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একইভাবে, ট্রাম্পের নিযুক্ত কমিশনার অফ ফেডারেল কমিউনিকেশন, অজিত পাই চীনের শীর্ষ টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছেন। নতুন আইনের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার বিঘ্নিত করতে পারে এমন কোন প্রতিষ্ঠান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য কোন যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে পারবে না।
এখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন রেনমিনবি বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের রপ্তানী ও বিনিয়োগকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, তবে এটি চীনা মুদ্রা রেনমিনবিকে টার্গেট করে পদক্ষেপ কেবল সময়ের ব্যাপার হতে পারে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর চীনা মুদ্রা রেনমিনবি ব্যবহারকে আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। র মধ্যে বিদেশী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে কারেন্সি সোয়াপ লাইন স্থাপন (মুদ্রা আদলবদল), চীনা আমদানীকারক ও রপ্তানিকারকদের রেনমিনবিতে তাদের ব্যবসায়িক লেনদেনের উৎসাহিত করছে। রেনমিনবিতে ডিপোজিট (আমানত) রাখার জন্য কর্পোরেশনের সামর্থ্যের বৃদ্ধি ও দ্রুত সম্প্রসারণ এবং হংকংয়ে অবস্থিত অফশোর রেনমিনবি বাজারে রেনমিনবি বন্ড ইস্যু করেছে চীন। আগামী বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের সমকক্ষ মুদ্রা হিসেবে রেনমিনবি’কে দাড় করাতে চাচ্ছে।
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্কিন ট্রেজারি সিকিউরিটিজের বৃহৎ অংশীদারিত্ব রয়েছে। তার দীর্ঘমেয়াদী মূল্যায়ন এবং ডলার এর অবমূল্যায়নে ও মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক অধপতনের কারনে চীনের অর্থনীতি যে কোন আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করে উদ্ধতন সরকারী কর্মকর্তাদের এক পক্ষ এবং রেনমিনবিরক ডলারের সমকক্ষ করার এই পদক্ষেপগুলো ব্যাপক বির্তক সৃষ্টি করে। চীন রেনমিনবিকে ডলারের বিকল্প হিসাবে তৈরী করছে। রেনমিনবিকেএকটি ট্রেডিং মুদ্রা হিসাবে এবং বিদেশী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে জোর কূটনৗতৈক তৎপরতা চালাচ্ছে চীনের মুদ্রায় রিজার্ভ রাখার জন্য।
সবকিছু মিলিয়ে রেনমিনবি আন্তর্জাতিকীকরণ প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য মূলত অভ্যন্তরীন উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যেমন চীনে বড় ধরনের অভ্যন্তরীন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় এবং আর্থিক ব্যবস্থার উদারীকরণ সহজ হয়। আরেকটি বিষয় গুরুত্ব বহন করে তা হল চীনা রপ্তানিকারকদের জন্য খরচ কমানো এবং মুদ্রার বিনিময় হার ঝুঁকি এড়ানো।
আন্তর্জাতিক অর্থায়নের জন্য রেনমিনবিকে সম্পদ হিসেবে তৈরী করা, এর ব্যবহার বৃদ্ধি করা।চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মডেলের সাথে অভ্রন্তরীন মূলধন বরাদ্দ, বিনিময় হার, মূলধন প্রবাহ এবং নিজস্ব ঋণের খরচ কমানোর মাধ্যমে মৌলিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে রেনমিনবি ব্যবহার কার্যকর করা।
এদিকে, চীন ২০১৫ সালে একটি বড় মাইলফলক অর্জন করেছে, যখন ইন্টারন্যশনাল মানিটারী ফান্ড চীনা মুদ্রা রেনমিনবিকে মুদ্রা তহবিলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সম্মত হয়েছে।এবং রেনমিনবিকে সিন্থেটিক রিজার্ভ সম্পদ হিসেবে অনুমদোন দিয়েছে ও এসডিআর (ইস্পেশাল ড্রয়িং রাইট)মুদ্রা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর পূর্বে, এই বিশেষ সুযোগটি শুধুমাত্র মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানি ইয়েন এবং ইউরোতে কে দেওয়া হয়েছিল।এর ফলে রেনমিনবি’র আন্তর্জাতিক অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি চীন ক্রড ওয়েল লেনদেনের জন্য রেনমিনবিতে বিনিময় ইনডেক্স বাজারে এনেছে যা সরাসরি মার্কিন ডলার কে চ্যালেঞ্জ করছে বলে কিছু পর্যবেক্ষক মনে করছেন। বৈশ্বিক প্রভাবের ক্রমবর্ধমান উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষার অংশ হিসেবে চীন তার মুদ্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চীন। নিজেকে অপ্রতিরোদ্ধ সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই এখন দেশটির একমাত্র লক্ষ্য। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের প্রভাবশালী অবস্থানের কারনে মার্কিন ডলার আর্থিক বাজার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী আবস্থানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক সুবিধা ভোগ করে। চীন এখন রেনমিনবিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সেই সব সুবিধায় ভাগ বসাতে চায়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে ডলারের একক আধিপত্য ধরে রাখার বিষয়ে মার্কিন নীতি মূলত সহিষ্ণু অবস্থায় ছিল। যদিও তা চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক প্রকাশ করে না। এমনকি যখন এটি স্পষ্ট ছিল যে চীন রেনমিনিকে ডলারের বিকল্প হিসেবে উন্নীত করছে, তখন ওবামা প্রশাসনের গভর্নর জেনারেল জারিফের প্রতিরক্ষার পক্ষে খুব সামান্যই পদক্ষেপ গ্রহন করেছিল। প্রকৃত পক্ষে রেনমিনবির মুদ্রা হিসেবে গ্রহন যোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহের সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসডিআর(ইস্পেশাল ড্রয়িং রাইট)মুদ্রা তালিকায় রেনমিনবি’র প্রবেশের সমর্থন দিয়েছিল, কারণ এটি বর্তমান মুদ্রানীতিতে চীনকে আরও নির্ভরযোগ্য স্টেকহোল্ডার হিসাবে উৎসাহিত করতে চেয়েছিল।
কিন্তু তারপর ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলেন, এবং সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেন। যদিও এতদিনে রেনমিনবির আন্তর্জাতিক অবস্থান বেড়েছে, চীনের মুদ্রাকে প্রধান মুদ্রার অবস্থান নিতে হলে দীর্ঘ পথ পাড়ী দিতে হবে। ট্রাম্প, স্ব-ঘোষিত সিদ্ধান্ত গ্রহনকারী, সম্ভবতঃ তিনি এই বিষয়টি জানেন, এবং রেনমিনবিকে দুর্বল করার চেষ্টা করবেন।
উদাহরণস্বরূপ, যদি চীন বাণিজ্যের উপর রেগুলেশনের জন্য ট্রাম্পের দাবির শক্ত বিরোধিতা করতে চায়,তবে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের জন্য তাদের চীনা ব্যবসায়ীকঅংশীদারদের সাথে রেনমিনবিতে লেনদেন নিষিদ্ধ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় ব্যাংক। অবশ্যই এর ফলে রেনমিনবির পতন অবধারিত হবে।
অবশ্যই, একটি বাণিজ্য যুদ্ধের পাশাপাশি একটি মুদ্রা যুদ্ধ বিপজ্জনক, এবং সম্ভবত মারাত্বক বিধ্বংসী হবে।এত আর্থিক বাজার চরমভাবেঅস্থিতিশীল হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক ঋণ বিতরন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। দুর্ভাগ্যবশত, একজন ব্যক্তি যিনি মনে করেন যে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ ভাল, এবং জয় করা সহজ’ এবং এটাতেই বিশ্বাস করেন। আমরা শুধু আশা করতে পারি যে এর একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে।
সূত্র: ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক বেঞ্জামিন জে কোহেন-এর মুদ্রা শক্তি (মানিটারী পওয়ার) সম্পর্কে লিখিত প্রবন্ধ অবলম্বনে
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment