কারবালার শোকের স্মৃতিতে অনন্য হোসনি দালান
লেখা ও ছবি: এম মামুন হোসেন
সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো মোগল আমলের ঐতিহ্যের নিদর্শন হোসেনি দালান বা ইমামবাড়া শিয়া উপাসনালয় এবং কবরস্থান। ৬১ হিজরির ১০ মহররম অর্থাৎ ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেন নির্মমভাবে শহীদ হন। তাঁর স্মরণে স্মৃতিসৌধ হিসেবে নির্মাণ করা হয় এই হোসনি দালান।
ইসলামিক পঞ্জিকা অনুযায়ী মুহররমের দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। শিয়া মুসলমানরা তাজিয়া মিছিল, মাতম ও শোকানুষ্ঠান করে দিনটিকে স্মরণ করে।
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে হোসেনি দালান ঘুরে আসতে পারেন। প্রধান প্রবেশপথে রয়েছে দারুল কোরআন লাইব্রেরি। মূল ফটক শেষে পশ্চিম দিকে রয়েছে দারুল শেফা হাসপাতাল। শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের সমাজসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই হাসপাতাল। এর উত্তরাংশে শিয়া বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের কবরস্থান।
দালানটি সাদা বর্ণের এবং এর বহিরাংশে নীল বর্ণের ক্যালিগ্রাফি বা লিপিচিত্রের কারূকাজ রয়েছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। অভ্যন্তরে রয়েছে সুদৃশ্য নকশা। পূর্বদিকের সিঁড়ির সাহায্যে এই মঞ্চে উঠতে হয়।
পাশাপাশি সংযুক্ত দুটি হলরুম নিয়েই মূল ইমারতটি। এর মধ্যে দক্ষিণমুখী ‘শিরনি’ হলটি ইমাম হুসাইনের মৃত্যুর জন্য দুঃখ ও শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। উত্তরমুখী ‘খুতবা’ হলে রয়েছে সাত ধাপবিশিষ্ট একটি কাঠের তৈরি মিম্বার। শেষের হলরুমটিতে ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতীক ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই দুটি হলের ডানে ও বামে নারীদের জন্য দ্বিতলবিশিষ্ট সম্পূরক হলরুম নির্মিত হয়েছে। দক্ষিণ দিকের সম্মুখভাগের দুই প্রান্তে দুটি তিনতলা বহুভুজ ফাঁপা বুরুজ রয়েছে। বুরুজগুলোর শীর্ষে রয়েছে গম্বুজ।
মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি নির্মিত হয়। এর নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ইমামবাড়ার দেয়ালের শিলালিপি থেকে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তাঁর নৌ-সেনাপতি মীর মুরাদ ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। প্রচলিত লোককাহিনি অনুসারে, নৌ-সেনাপতি মীর মুরাদ একদিন স্বপ্নে আল হোসেনকে একটি ‘তাজিয়াখানা’ নির্মাণ করতে দেখে এটি নির্মাণে উৎসাহিত হন। তিনিই এই ইমারতের নাম রাখেন হোসেনি দালান।
ঐতিহাসিক এম হাসান দানীও বলেছেন, মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। পরে এটি ভেঙে যায় এবং নায়েব-নাজিমরা নতুন করে তা নির্মাণ করেন। ইতিহাসবিদ জেমস টেলর তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন, ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসানউল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ইরান সরকারের উদ্যাগে হোসেনী দালানের ব্যাপক সংস্কার করা হয়। ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা এতে অংশ নেন। বর্তমান কাঠামোয় তাই ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।
আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি।
কারবালায় এক অসম যুদ্ধে ইমাম হুসাইন এবং তার ৭২ জন সঙ্গী শাহাদৎ বরণ করেন। শিমার নিজে গলায় ছুরি চালিয়ে ইমাম হুসাইনকে হত্যা করে। হত্যার আগমুহূর্তে ইমাম হোসেন বলেন, ‘আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যদি মুহাম্মদের দ্বীন জীবন্ত হয়, তবে আমাকে তরবারি দ্বারা টুকরো টুকরো করে ফেল।’
দিনরাত ভক্তরা ভিড় জমান ইমামবাড়ায়। মহররমের ১ থেকে ১০ তারিখ হোসনি দালান ঢাকা শহরের মূল আকর্ষণে পরিণত হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে সমবেত হয়ে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলে মাতম করতে থাকেন।
হোসেনী দালানের দক্ষিণাংশে রয়েছে একটি বর্গাকৃতির পুকুর। পুকুরে স্থাপনাটির ছায়া পড়ে অনন্য এক রূপ নিয়েছে। আজও অনন্য হোসেনি দালান।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment