কেমন আছেন মিয়ানমারের মুসলমান নাগরিকেরা?
সংবাদ বাংলা: মিয়ানমারের সাবেক রাজধানী, সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গনের একদম কেন্দ্রে চার রাস্তার এক মোড়ে একদিকে প্যাগোডা, আরেকদিকে বহু পুরনো একটি মসজিদ। সেখান থেকে দু’পা এগোলেই একটি হিন্দু মন্দির এবং খুব কাছেই একটি গির্জা। মিয়ানমার বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে হলেও যুগ যুগ ধরে ধরেই নানা ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ এখানে বসবাস করেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা
কিন্তু বছর দশেক আগে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের মুসলমান নাগরিকদের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রাষ্ট্র এবং সমাজে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-বৈষম্য, ঘৃণা বাড়ছে। ইয়াঙ্গনের তিনজন মুসলিম বিবিসির সংবাদদাতা নিক বিকের কাছে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
অং নাইং সো, ফটোসাংবাদিক বলেন, ২০১৬ সালে হঠাৎ আমাকে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করা শুরু হলো। ফেসবুকে আমার ছবি ছড়িয়ে পড়লো। একদল কট্টর জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ এ কাজ শুরু করে। সন্ত্রাসীদের কোন একটি ভিডিওতে একজনের চেহারার সাথে আমার মিল ছিল। সেই ভিডিও’র একটি স্ক্রিনশট নিয়ে আমার মুখের ছবির সাথে তা পাশাপাশি রেখে সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হলো। তারপর থেকে মুসলমান এই ফটো সাংবাদিক অং নাইং সো অনলাইনে টার্গেট হয়ে গেলেন।
২০১৬ সালে হঠাৎ আমাকে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করা শুরু হলো। ফেসবুকে মানুষ কিছু না বুঝেই, না জেনেই আমার বিরুদ্ধে ঘৃণা উগরে দিতে শুরু করলো। পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন হয়ে উঠলো, যখন ভিন্ন একটি ঘটনায় পুলিশ তাকে আটক করে। টানা ১১ দিন ধরে আমাকে জেরা করা হয়। তারপর পুলিশ ২০১৬ সালে ফেসবুকে পোস্ট করা সন্ত্রাসী ভিডিও দেখিয়ে বলে আমিই নাকি সেই সন্ত্রাসী। এই ঘৃণার কারণ আমি ঠিক বুঝতে পারি না। সরকারি কর্মকর্তাদের মনের ভেতর যেন মুসলিমদের ভেতর চরম এক ঘৃণা জমে রয়েছে। তারা যেন মুসলিমদের সহ্যই করতে পারে না।
অং নাইং সো’র ব্যাপারে বিবিসি জানতে চাইলে, সরকারি কর্মকর্তারা কিছুই জানাননি। মাত্র কয়েক বছর আগ পর্যন্ত মিয়ানমার কার্যত একটি বিচ্ছ্নি দেশ ছিল। পাঁচ দশক ধরে সামরিক শাসনের সময়ে জেনারেলরা তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কৌশল হিসাবে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে উস্কানি দিয়ে গেছেন। ফলে ধীরে ধীরে দেশের অন্য সংখ্যালঘুরা অবজ্ঞার শিকার হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উস্কানি দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয় কট্টর বৌদ্ধ ধর্মীয় কিছু নেতাকে।
এখন সেই ঘৃণার টার্গেট হচ্ছে মিয়ানমারের যে কোনো মুসলিম। আর এই ঘৃণা ছড়ানোর পেছনে পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে সোশ্যাল মিডিয়া – বিশেষ করে ফেসবুক।
টিন অং মিন্ট, ইয়াঙ্গনে মুসলিম অধিকার কর্মী বলেন, এমনকী ইয়াঙ্গনের মতো শহরেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, হেনস্থা বাড়ছে। প্রতিদিন আপনি সোশ্যাল মিডিয়াতে মুসলিমদের নিয়ে মনগড়া সব খবর দেখবেন। ফটোশপ করে ছবি পোষ্ট করতে দেখবেন। কিন্তু এগুলোর বিরুদ্ধে কিছু করার কোনো উদ্যোগ কারো মধ্যেই নেই। এ ধরণের কোনো একটি বিষয় পোস্ট করা হলেই তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন বুঝতে পারি, এ নিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রধানত সে কারণে টিন অং মিন্ট ফেসবুকে একটি পর্যবেক্ষণ গ্রুপে নাম লিখিয়েছেন । এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। সোশ্যাল মিডিয়াতে মুসলিম বিদ্বেষী বিভিন্ন পোস্টের দিকে এরা নজর রাখেন।
আমরা নিজেদের এদেশের নাগরিক মনে করি, কিন্তু তারা আমাদের ভিন্ন কিছু ভাবে। এরকম বৈষম্য চলতে থাকলে মুসলমানরা আরো বেশি করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।মিয়ানমারের সরকার দাবি করে যে দেশের সব ধর্ম-বর্ণের নাগরিক সমান মর্যাদা ভোগ করে। কট্টরপন্থী বৌদ্ধ নেতাদের ওপরও তারা চড়াও হচ্ছেন। কিন্তু সরকারের কথা মুসলিমরা একবিন্দুও বিশ্বাস করেন না।
বিবিসির নিক বিক বলছেন, সত্যি কথা বলতে কি, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে নির্যাতন, যে অপরাধ হয়েছে, তা নিয়ে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের বিন্দুমাত্র কোনো মাথাব্যথা নেই । আর তাতেই মুসলমান এবং অন্য সংখ্যালঘুরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
খিন সান্ডার, মানবাধিকার কর্মী, ইয়াঙ্গন বলেন, পরিচয়পত্র নবায়ন করতে গিয়ে আমার দু বছর লেগেছে। অথচ বৌদ্ধরা দু সপ্তাহ বা বড়জোর ২৮ দিনের ভেতরে তা পেয়ে যায়। আপনি যদি চাকরির জন্য আবেদন করেন আর আপনি যদি মুসলিম হন, তাহলে ঐ চাকরি হয়তো আপনি পাবেন না। পরিচয়পত্র বা নাগরিক কার্ড নবায়ন করা এখন মুসলমানদের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি যখন আবেদনপত্র পূরণ করছিলাম, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বুঝে ফেলেন যে আমি মুসলমান। তিনি আমার মুখের ওপর বললেন ‘তুমি একজন কালায়া, আমি তোমার কাজ করে দেবো না। মিয়ানমারে মুসলমানদের ছোটো করতে ‘কালায়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলাম, রেগে গিয়েছিলাম।
রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরুর পর থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে, আর মানুষও যেন তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখতে শুরু করেছে – অমি বৌদ্ধ, আমি খ্রিষ্টান, আমি মুসলিম …। নেতাদেরকে উঁচু নৈতিক মূল্যবোধ লালন করতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে সমাজে বৈচিত্র্য গ্রহণযোগ্য, সুন্দর।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment