ঘুণেধরা ঐতিহ্যে টিকে আছে ’ডাকঘর’
মোহাম্মদ রেদওয়ান আতিক: অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে সম্ভবত ই-মেইলের সস্তা ডাক সেবা ছাড়া একটি বিশ্বের কল্পনা করা বড্ড কঠিন হতে পারে। তবে ২শ বছর আগেও চিঠি বা ডাক পাঠানো ছিল চরম এক বিলাসিতা। লন্ডন থেকে অ্যাডিনবার্গ পর্যন্ত একটি চিঠি পোস্ট করার খরচ ছিল একদিনের দৈনিক মজুরির সমান। ১৮৪০ সালে রোল্যান্ড হিল যাকে আধুনিক পোষ্টাল ব্যবসার জনক বলা হয়। তিনি অগ্রীম অর্থগ্রহন, চিঠিপত্রের নিরাপদ, দ্রুত এবং সস্তা ট্রান্সফারের সুবিধার ভিত্তিতে ডাক ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব করেন। পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে ব্রিটেনের পেনি পোষ্টটি (প্রতি অক্ষরের জন্য এক পেনি) যাত্রা শুরু করে।এটিই বিশ্বের প্রথম সর্বজনীন ডাক সার্ভিস। ওই সময়ের এই সুলভ ডাক ব্যবস্থাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তথ্যের প্রবাহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে বলে প্রমাণ করে। কম খরচেও এই ডাকসেবা থেকে মুনাফা হতো এবং সরকার রাজস্ব আয়ের জন্য ডাকসেবার উপর আয়কর ও চালু করেছিল।
পরের শতকে সমগ্র উন্নত বিশ্ব জুড়ে ডাকসেবা ছড়িয়ে পড়ে।শিল্প উন্নয়নের যুগে ২০০৭ সালে ডাকঘর বিশ্বব্যাপী সালে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন চিঠি বিতরণ করেছে।কিন্তু গত দশকে এই মডেলটির মাধ্যমে চিঠি প্রেরনের পরিমান কমে যায় এবং জিগ-অর্থনৈতিক সংস্থাগুলী স্বাধীন (ঠিকাদার এবং ফ্রিল্যান্সার) এবং পার্সেল ডেলিভারির প্রসারিত ই-কমার্স জায়ান্টদের কাছ থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।সারাবিশ্বের মতো আমেরিকায় ডাকসেবা বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রীয় ইউনাটেড ষ্টেট পোষ্টাল সার্ভিস (ইউএসপিএস) এর অর্থায়ন পরীক্ষা করার জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেন। গত মাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউনাটেড ষ্টেট পোষ্টাল সার্ভিসের আর্থিক ক্ষতির জন্য টুইটারে ই-কমার্স জায়ান্ট আ্যমাজনকে দায়ী করেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চালাকি। কারণ সবার জানা, জ্যাফ বোজাসের (অ্যামাজন এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক) সাথে ট্রাম্পের সর্ম্পক ভালো নয়।
কিন্তু এটা সত্য যে, ইউনাটেড স্টেট পোষ্টাল সার্ভিস মারাত্মক আর্থিক সমস্যায় আছে। ২০০৮ সাল থেকে রাজস্ব ৩৫ শতাংশে কমে গেছে এবং এটি ২০০৬ সালে ইউনাটেড স্টেট পোস্টাল সার্ভিস (ইউএসপিএস) শেষবার মুনাফা করেছে। কারন ব্যাংক ষ্টেটমেন্ট, বিদ্যুত বিল প্রেরনে ডাকের পরিবর্তে ই-মেইল ব্যবহার বেড়েছে। ব্যক্তিগত চিঠি এবং উপহার কার্ড প্রেরনের অভ্যাস থেকে মানুষ বেরিয়ে আসছে। এমনকি সরকারী সেবাতে ও অনলাইন ব্যবস্থা চালু হয়েছে যা ডাক ব্যবস্থা বিলুপ্তি করবে। ডেনমার্ক ২০১৬ সালে এই সেবা বাতিল করেছে।
তবে পার্সেল সার্ভিস ডাকসেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ২০১৪-২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী প্যাকেজ পার্সেল সার্ভিস পরিমান ৪৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ পোস্ট অফিসগুলোকে আধুনিকায়নের জন্য বড় বিনিয়োগ করতে হবে।বিনিয়োগকারীরা গিগা-অর্থনীতির কুরিয়ারে টাকা ঢালছেন যা সস্তা। বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ ( বিসিজি) মনে করে যে এই ধরনের সংস্থাগুলির বিনিয়োগ ২০১৪-১৬ অর্থবছরে ২০০ মিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। পোস্ট অফিসগুলো শ্রমিক ইউনিয়ন, অতিরিক্ত খরচ এর কারনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক পার্সেল ব্রোকার কোম্পানি পার্সেল হিরোর কনজিউমার রিসার্চ এবং পাবলিক রিলেশনস প্রধান ডেভিড জিনস বলছেন,দীর্ঘদিন ধরে জিগ কুরিয়ররা বেঁচে থাকবে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয় কারন গতমাসে স্টার্টআপস এবং উবারের মালিকানাধীন উবাররাশ এ্যাপ ভিওিক সেবা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অভাবে নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ করে।আবার কোন কোন কোম্পানি কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের আভাব,ছুটির অসঙ্গতি,কম বেতনের কারনে ও বন্ধ করতে বাধ্য হবে।যেমন:ব্রিটেনের ডিপিডি।শ্রমিক মজুরীর উর্দ্ধগতি কারনে গিগ কুরিয়ার কোম্পানীগুলোর সস্তা সেবা দেয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
ই-কমার্স জায়ান্ট একটি বড় ধরনের হুমকি প্রমাণ হতে পারে। যদিও তারা পোষ্ট অফিস তুলনায় সস্তায় সর্ভিস দেয় না কিন্তু তারা ডোর টু ডোর ডেলিভারি করে।অ্যামাজন ইতোমধ্যেই নিজের ডোর টু ডোর ডেলিভারি শুরু করে ব্রিটেনের রয়্যাল মেলকে(যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বিশ্বস্ত চিঠি এবং পার্সেল ডেলিভিারী সংস্থা) ব্যবসায় আঘাত করেছে। অ্যামাজন ক্যালিফোর্নিয়ায় ব্যবসার বৃহত্তর স্বার্থে মুদি পন্য বিতরন সেবা কার্যক্রম শুরূ করেছে।সব থেকে বড় হুমকি অ্যামাজন এর চীনা প্রতিদ্বন্দ্বী, আলিবাবা থেকে আসতে পারে কারন ইতি মধ্যিই আলীবাবা তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান কাইনিওতে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যা সারাবিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।শহরে নিজস্ব বিতরন ব্যবস্থায তারা যে পরিমান মুনাফা করে তাতে গ্রামীন পর্যায়ে পন্য ডেলিভারীতে ক্রস-ভর্তুকি দিতে কোন আসুবিধায় পড়তে হয় না।
এর মানে এই নয় যে পোস্ট অফিসগুলোকে সরকারীভাবে সুরক্ষা প্রদান করা বরং তাদেরকে প্রতিযোগীতার জন্য তৈরী করা প্রয়োজন।পৃথিবীর দ্রুততম পরিবর্তনশীল পাঁচটি সংস্থার মধ্যে চারটি সিঙ্গাপুর পোস্ট, পোষ্ট ইটালীয়, বেলজিয়ামের বি পোস্ট এবং অস্ট্রিয়ান পোস্ট – ব্যক্তিগত মালিকানাধীন এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সরাসরি প্রতিযোগীতা করছে।জার্মানির ডাচ পোস্ট ডিএইচএল এর প্রধান নির্বাহী ফ্রাঙ্ক অ্যাপেল বলেছেন এই দশকে তার কোম্পানী ৩০ শতাংশ পরিচলনা ব্যয় কমিয়ে আনবে এবং ই-কমার্সের ব্যবসার বৃদ্ধিকে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান কর্মসংস্থান বজায় রাখবে বলে জোর দেয়।বাংলাদেশে ও এই পরিবর্তনে হাওলা লেগেছে গিগ কুরিয়ার কোম্পানীগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য বাংলাদেশ পোষ্ট আফিস বাল্ক মেইল সার্ভিস চালু করেছে যা কুরিয়ার সার্ভিস এর বিকল্প হিসেবে এক সাথে অনেক চিঠি পাঠায় বিশেষ করে ব্যাংক,বীমা,লিজিং কোম্পানী তারা এটি ব্যবহার করে অনলাইনে ডেলিভারী তথ্য ও পাবেন। এছাড়াও ই-পোস্ট – ইলেকট্রনিক মেইল সার্ভিস যা বিভিন্ন দেশের চিঠি, দলিল, বার্তা পাঠায়। ডাক লাইফ ইন্স্যুরেন্স – বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য, কোনও মুনাফা ছাড়াই সরকার চালায়। সঞ্চয়পত্র সার্টিফিকেট – এটা সরকারের একটি সঞ্চয় সংকলন প্রকল্প। মানি অর্ডার – মানি অর্ডার হল পোস্ট অফিসের এজেন্সির মাধ্যমে অর্থ প্রদান। এখন মোবাইল এর মাধ্যমেস্বল্প খরচে পোষ্ট আফিস থেকে টাকা তোলা যায়। ডাক আদেশ(পোষ্টাল অর্ডার) – একটি নিবন্ধিত আরো নিরাপদ চিঠি স্থানান্তর প্রক্রিয়া। জিইপি, ইপপ – ডোমেস্টিক এক্সপ্রেস সার্ভিস আরো নিরাপদ ও দ্রুত ডেলিভারির আশ্বাস দেয়। ইএমএস(এক্সপ্রেস মেল সার্ভিস)- দ্রুত নির্ভরযোগ্য ও যথাযথ আন্তর্জাতিক পরিষেবা হলো ইএমএসের মূল উদ্দেশ্য।
অ্যামাজন ড্রোন ব্যবহার করে ডোর টু ডোর পন্য পোঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু তা নিয়ন্ত্রক অনুমোদন পেতে ও কার্যক্রম শুরু করতে কয়েক বছর লাগবে। পোস্ট অফিসগুলোর সেবায় কিছু বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।রয়েল মেইলের বেশ কয়েকটি প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে, তবে কেউ এখনও পর্যন্ত প্রায় সকল ধরনের চিঠিপএ ডোর টু ডোর ডেলিভারীতে সফলতা পায়নি। প্রতিযোগিতার জন্য অন্যান্য ইউরোপের দেশের জন্যও একই কথা সত্য। ডাক সংস্থাগুলো বেঁচে থাকতে পারে যদি তারা যুগের পরিবর্তন কে মেনে নিয়ে নিজেদের কাজের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে প্রস্তুত থাকে।রোল্যান্ড হিল, তার নিজের যুগে যে সংস্কার করেছিলেন, বর্তমান সময়ে তিনি এই পরিবর্তনের সমর্থন করতেন কী? (দি ইকোনমিষ্ট অবলম্বনে)
.
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment