চলুন জেনে আসি ব্রিটিশ রাজ-পরিবারের সম্পদের খোঁজ-খবর
মোহাম্মদ রেদওয়ান আতিক
ব্রিটিশ রাজ পরিবারের একজন নতুন মেহমানের আগমন হয়েছে: প্রিন্স উইলিয়ামের স্ত্রী কেট মিডলটন ফের পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। এ নিয়ে তৃতীয় সন্তানের জনক হলেন প্রিন্সেস ডায়ানার বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম। এই বছরের ২৩ এপ্রিল সোমবার কেট এবং উইলিয়াম স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় ছেলে সম্তানের বাবা-মা হয়েছেন কেট ও উইলিয়াম। ২০১৩ সালের ২২ জুলাই জন্ম হয় প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলটনের প্রথম সন্তান জর্জের। এর ঠিক দু’বছর পর জন্ম হয় প্রিন্সেস শার্লটের। বলার অপেক্ষা রাখে না-এই নতুন অতিথিকে কখনোই অর্থ উর্পাজনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না বা কাজ করার প্রয়োজন পড়বে না। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৯২ বছর বয়স (জন্ম: ২১ এপ্রিল ১৯২৬) তার নিট সম্পদের মূল্য ৬শ মিলিয়ন ডলার (৪৮ হাজার কোটি টাকা) এবং প্রতি বছর যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে রাজতন্ত্র বা রাজপরিবার ২.৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ বৃদ্ধি করে। এছাড়াও রয়েছে ক্রাউন জুয়েলারী ও ক্রাউন এস্টেট। ক্রাউন জুয়েলারী যা শুধু মাত্র রাজা ও রাণী ব্যবহার করতেন তার মূল্য হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। ক্রাউন এস্টেটের সম্পদ মূল্য নিরূপন করা কঠিন কাজ হবে। মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কেল প্রিন্স হ্যারিকে বিয়ে করে রয়্যাল পরিবারে যুক্ত হয়েছেন। তার সম্পদ ও রাজপরিবারে মোট সম্পদে যোগ হবে। মেগানের সম্পদের পরিমান ৫ মিলিয়ন ডলার।
ক্রাউন জুয়েলারী: প্রায় ৬শ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো রাজা এবং রানীর রাজত্বের মুকুট, পোশাক এবং অন্যান্য আইটেম টাওয়ার আফ লন্ডনে সুরক্ষিত আছে। ৪১৮ বছর আগে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ক্রাউন জুয়েলর্স বা জুয়েলারী কে সংরক্ষন করার জন্য টাওয়ার অফ লন্ডনে রাখা হয়। লন্ডনের টাওয়ারে ১৪০ টি রাজকীয় জিনিস রাখা হয়, যেগুলো ব্রিটিশ রাজারা এবং রানীগণ ব্যবহার করতেন, যা তাদের রাজ্যের রাজাদের রাজকীয়তা প্রকাশ করে। ক্রাউন জুয়েলর্স দেখার জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ টাওয়ার অফ লন্ডন পরিদর্শনে আসেন। টাওয়ারে বর্তমান স্থাপনায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন (৩ কোটি) মানুষ এ ক্রাউন জুয়েলর্স পরিদর্শন করেছেন। এটি যুক্তরাজ্যের অনন্য সংগ্রহশালা। প্রায় প্রতিবছর সংসদ অধিবেশন এবং রাজকীয় আনুষ্ঠনের সময় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ইম্পেরিয়াল স্টেট ক্রাউন পরেন। তখন রানীর ব্যবহারে জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ওয়েস্ট মিনস্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।ওয়েস্ট মিনিস্টারটি বাকিংহাম প্যালেসের কাছাকাছি বিস্তৃত সরকারি এলাকা, প্রাচীন থেমস নদীর পাশ দিয়ে প্রবাহীত হয়েছে। বাকিংহাম প্যালেস হল লন্ডনের রাজকীয় প্রশাসনিক সদর দপ্তর ও রানীর বাসবভন।
ক্রাউন এস্টেট: ঐতিহাসিকভাবে, ক্রাউন এস্টেটের সম্পত্তি রাষ্ট্রের শাসনকর্তা দ্বারা পরিচালিত হয় যাতে তিনি দেশের শাসন পরিচালনা করতে পারেন।১৭৬০ সালে রাজা জর্জ তৃতীয় সিংহাসনে অরোহন করার পর রাজ্য পরিচালনা থেকে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাপনাকে পৃথক করেন।রাজকীয় বিভিন্ন জমিজমার আয় থেকে উদ্বৃত্ত সরাসরি যাবে রাষ্ট্রের কোষাগারে এবং এরফলে জর্জ তৃতীয় বেসামরিক পরিষেবা, প্রতিরক্ষা খরচ, জাতীয় ঋণ, এবং নিজের ব্যক্তিগত খরচের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধতার দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করেন।সাথে সাথে তিনি একটি বার্ষীক আনুদান গ্রহন করার সিদ্ধান্ত নেন নিজের ও রাজপরিবারের সদস্যদের খরচ নির্বাহের জন্য, যা সিভিল লিষ্ট নামে পরিচিত। পরবর্তী সকল রাজা বা রাণীই এই ব্যবস্থাটি গ্রহন করেন।সিভিল লিষ্ট পরিবর্তীত নামে ‘সভেরেইন গ্রান্ট বা সার্বভৌম অনুদান’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রাউন এস্টেটটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান। এর মোট সম্পদের পরিমান ১২ বিলিয়ন পাউন্ড বা ১৬.১২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৯.১ বিলিয়ন পাউন্ডের মূল্যমান শহুরে সম্পদ যার বেশীর ভাগই সেন্ট্রাল লন্ডনে আবস্থিত। এছাড়াও ৭ লক্ষ৯২ হাজার হেক্টর (১৯ লক্ষ ৬০ হাজার একর)কৃষি জমি এবং বন রয়েছে ক্রাউন এস্টেট এর নিয়ন্রনাধীন,যা যুক্তরাজ্যের মোট কৃষি জমির অর্ধেকের বেশি। এসকোট রেসকোর্সসহ অন্যান্য অন্যান্য ঐতিহ্যগত হোল্ডিংস, উইন্ডসর প্রাসাদ, উইন্ডসর গ্রেট পার্ক (২০২০ হেক্টর বা ৫০০০ একর) জমির উপর তৈরী রয়েল পার্কটি বার্কশায়ার সীমান্তে উইন্ডসর শহরের দক্ষিণে অবস্থিত এখানেই প্রিন্স হ্যারী ও মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কেলের রাজকীয় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ১৫৬৮ সালে রাণী প্রথম এলিজাবেথের প্রতিষ্ঠা করা মাইনর্স রয়েল কোম্পানী যেটি সমগ্র যুক্তরাজ্যে খনি থেকে উৎপাদিত স্বর্ণ ও রৌপ্যর মালিকানা আর্জনকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি। এটি ক্রাউন এস্টেট দ্বারা পরিচালিত এবং খনির অপারেটরদের উপর ভাড়া দেওয়া হয়।
সভেরেইন গ্রান্ট: যুক্তরাজ্যের করদাতারা রাজ-পরিবারকে “সার্বভৌম অনুদান” বা ‘সভেরেইন গ্রান্ট’ এর মাধ্যমে সাহায্যে করে থাকে যা রাষ্টের কোষাগারে জমা পড়ে। এই বছর, অনুদান ১০৪.৮ মিলিয়ন ডলার, যা ব্রিটিশ করদাতার মাথাপিছু এক পাউন্ডের চেয়ে কম।টাকার অংকে তা মোটেও খারাপ না।এবং এর জন্য ব্রিটিশ করদাতারা যে পরিমান আনুদান দেন তা দিয়ে এক কাপ কফি বা একটি ক্যান্ডিবার এর সমমূল্য হবে না। দি ব্রিটিশ ট্রেজারী তার অফিসিয়াল কর্তব্যের অংশ হিসাবে রানী এলিজাবেথ খরচ বহন করার জন্য রাণীকে সার্বভৌম দান হিসাবে পরিচিত একটি পরিমাণ অর্থ প্রদান করে। এই ব্যয়গুলির মধ্যে ভ্রমণ, বিনোদনমূলক, এবং বিভিন্ন দুর্গ ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত।সভেরেইন গ্রান্ট বা অনুদান মূলত হিসাব করা হয় ক্রাউন এস্টেটের বার্ষিক মোট মুনাফার ১৫শতাংশ।ক্রাউন এস্টেট যদি কোন বছর কম আয় করে তবুও সভেরেইন গ্রান্ট হিসেবে রাজ পরিবারকে তার আগের বছরের চেয়ে কম আনুদান দেয়া যাবে না। এবং বাকিংহাম প্যালেসের সংস্কারের জন্য অনুদান ১৫% শতাংশ থেকে ২৫% শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।সার্বভৌম অনুদানের অর্থ ট্যাক্স-মুক্ত।
ছবি: টাওয়ার অফ লন্ডন
রানী এলিজাবেথের আয়: রানীর নিজস্ব ব্যক্তিগত আয় রয়েছে। তিনি ব্রিটেনের বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় করেছেন। তার ৬০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যর সম্পদের উপর কোন আয়কর দিতে হয় না। এর পরও রানী ১৯৯২ সাল থেকে আয়কর দেওয়া শুরু করেন।১৯৩০ সালের পর তিনিই প্রথম ব্রিটিশ রাজ পরিবারের একজন যিনি আয়কর দেওয়া শুরূ করেন। কুইন এলিজাবেথ তার বেশিরভাগ প্রাসাদগুলির মালিক নয়।এইগুলিকে জাতীয় সম্পদ এবং রাজকীয় সংগ্রহের অংশ হিসাবে গণ্য করা হয়। এর মধ্যে ক্রাউন জুয়েলর্স ও অর্ন্তভুক্ত।রাজত্বকালীন সময় তাদের ভোগ এবং ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়।রাজকীয় সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে রাজকীয় বাসস্থানগুলির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ছবি, আসবাবপত্র, টেপস্ট্রিস্ট, ফটোগ্রাফ এবং অন্যান্য আইটেম। বাকিংহাম প্যালেস ও উইন্ডসর কাসলও ক্রাউন এস্টেট এর মাধ্যমে পারচালিত। তারা রাজত্বের শাসক হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন কিন্তু তা বিক্রয়ের অধীকার রাখেন না। কুইন এলিজাবেথের ৬৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের স্যান্ড্রিংহাম হাউস রয়েছে। স্যান্ড্রিংহাম, নরফোক, ইংল্যান্ডের কাছে একটি দেশীয় বাড়ি। এটি কুইন এলিজাবেথ দ্বিতীয় এর ব্যক্তিগত বাড়ি। বাড়ির একটি অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নরফোক উপকূল এলাকায় ২০ হাজার একর জমির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ও ১৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের স্কটিশ এস্টেট বারমোরাল কাসল মালিক রানী। এটি প্রায় ৫০ হাজার একর জমির উপর দাড়িয়ে আছে।বালমরাল কাসল ব্র্যাটারের পূর্বে ৬২ মাইল (১০ কিলোমিটার) ব্যালেটের পশ্চিম এবং ৬.৮ মাইল (১১ কিলোমিটার) ব্র্যাডারের কাছে অবস্থিত ক্র্যাথি গ্রামের কাছে স্কটল্যান্ডের রয়েল ডেসাইডের একটি বড় এস্টেটের বাড়ি।
রানী এলিজাবেথ এবং প্রিন্স চার্লস-এর অতিরিক্ত আয়
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং তার পুত্র প্রিন্স চার্লস এর মধ্যযুগীয় সময় থেকে চলমান ২টি ডুচী থেকে আয় আছে। ডুচি মানে এস্টেট বা দেশ বা ভুখন্ড। এই শব্দটি শুধুমাএ ব্রিটেনে ব্যবহার হয়। মধ্যযুগে ডুচি পরিচালনা করতেন ডিউক। ভ্ন্নি ভ্ন্নি ডুচিতে ডিউক নিয়োগ করা হত।সম্মানের দিক থেকে রাজা ও রানীর পরে তাদের অবস্থান ছিল।ল্যাঙ্কাস্টারের ডুচি একটি প্রাইভেট এস্টেট যা জন এন্ডওয়ার্ড তৃতীয় -এর পুত্র জন গন্টের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৩৯ সাল থেকে সম্রাটের কাছ থেকে সম্রাট সম্পদটি উওরাধিকারী হয়েছেন। এই ডুচিটি থেকে আয় রানী এলিজাবেথের জন্য ব্যক্তিগত আয়।পানামা পেপার পত্রিকা প্রকাশ করেছে যে এই ডুচি থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার কেম্যান দ্বীপ ও বারমুডাতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। রাজত্বকালের রাজত্বের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রিন্স চার্লস দ্বারা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ডুচিস অফ কর্নওয়ালের বয়স প্রায় ৬৮০ বছর।এই ডুচিটির ও মুনাফা আফশোর কোম্পানীতে বিনিয়োগ করার কারনে জনসম্মক্ষে আসে। কুইন এবং প্রিন্স চার্লস উভয়কেই এই জন্য ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়তে হয়। যতক্ষণ না একটি অফিসিয়ালি ঘোষনা আসে যে কুইন এবং প্রিন্স উভয়ই স্বেচ্ছায় আয়কর প্রদান করেন, যা থেকে শেষ পর্যন্ত দেশ উপকৃত হয়। #সেলিব্রেটি নেট ওর্থ অবলম্বনে
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment