ট্যাক্সের রিটার্ন কই?
এম মামুন হোসেন: সরকারি তথ্য বলছে, দেশের সাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশ। এই হিসাব নিয়ে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। তবে ক্রমান্বয়ে দেশে সাক্ষরতার হার বাড়ছে। ছোট্ট একটি দেশ, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমসীম খেতে হয়। সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। উন্নত দেশগুলোতে জনগণের কিছু ভাবতে হয় না। সব কিছুই সরকার ভাবে। সরকারের উপর নির্ভরতায় তারা নির্ভার। আমাদের সরকারের সেই সক্ষমতা নেই। অনেকে বলবেন সেই সদিচ্ছাও নেই। তাই আমরা ট্যাক্স দিতে চরম অনীহা প্রকাশ করি। ভাবি ট্যাক্সের রিটার্ন পাওয়া যায় না। আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে ট্যাক্সকে অপচয় মনে করি। লুটপাট আর বালিশ কাÐের মতো ঘটনায় আমরা শঙ্কিত হই। ব্যাংকে জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি এসব বিষয়গুলো আমাদের পীড়িত করে।
নতুন অর্থবছর এসেছে। ১ জুলাই থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট কার্যকর শুরু হয়েছে। এই বাজেটে নতুন নতুন ভ্যাট-ট্যাক্সের বোঝা ঝেঁকে বসেছে। এরসঙ্গে সঞ্চয়পত্রে করের হার ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বাড়তি চাপ ফেলেছে সাধারণ মানুষের উপর। সেপ্টেম্বর মাসে আয়কর জমা দিতে হবে। মনের মধ্যে ঘোরপাক খায় ট্যাক্স দিয়ে লাভ কী? ট্যাক্সের টাকার কোনও রিটার্ন নেই।
এবার আসি সরকার জনগণের জন্য কী করে? বা আপনার ট্যাক্সের টাকার কতটুকু আপনি রিটার্ন পাচ্ছেন। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ট্যাক্সের টাকায় আপনার সন্তান প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। মাত্র ২০ টাকা বেতনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছি। ১০ টাকার টিকিটে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছি। এতো এতো সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল সবকিছুই আপনার জন্য। সবই ট্যাক্সের টাকায় জনগণের সেবা দেওয়ার জন্য। তবে পার্থক্যটা কী? এতোসব সেবা প্রাপ্তির পরও কেন মনে হয়, ট্যাক্সের টাকার রিটার্ন পাচ্ছি না।
এর জন্য একটু ভূমিকা দিতে হবে। দেশে এখন ৬৩ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সরকারি মাধ্যমিক স্কুল, সরকারি কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র অর্থে লেখাপড়ার সুযোগ। কিন্তু এরপরও সন্তুষ্টি নেই কেন?
এর উত্তর হচ্ছে…‘মান’। ৬৩ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু সেসব স্কুলে কেউ তাদের সন্তানকে দিতে চান না। কেন দিতে চান না? এর উত্তরও হচ্ছে ‘মান’। এসব প্রতিষ্ঠান মানসম্মত নয়। এজন্য ব্যাঙের ছাতার মতো স্যুট-টাই পরা স্কুল-কলেজের দৌরাত্ম। গলাকাটা ফি দিয়ে অভিভাবকরা সেসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে ছুটছেন। এরও উত্তর হচ্ছে ‘মান’। আমরা কোনও কিছুতেই মান নিশ্চিত করতে পারছি না।
১০ টাকায় যে কোনও চিকিৎসাসেবা নেওয়া যায় সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে। সরকারি হাসপাতাল শুনলেই পিলে চমকে যায়। আবার এই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসককে দেখানোর জন্য লম্বা সিরিয়াল আর পকেট খালি করে তার প্রাইভেট চেম্বারে আমরা দৌড়াই। কেউ কেউ আবার পাশ্ববর্তী ভারত, থাইল্যান্ডে ভরসা খুঁজছেন। কিন্তু কেন? এর উত্তরও হচ্ছে ‘মান’।
খাবারে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, তেলে ভেজাল, এমন কী বাতাসেও ভেজাল। সব কিছুই মানহীন। জনগণ সরকারের ভালো পদক্ষেপ নিয়ে সন্তুষ্ট হচ্ছে না। কারণ এই ‘মান’। এতো বিস্তারিত ব্যাখ্যা শেষে উপসংহার টানলে যা দাঁড়ায় তা হলো আমাদের সবই আছে। কিন্তু সেসব মানহীন। সরকার যদি মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে সরকারের কাজে জনগণ খুশি হবে। সরকারের ট্যাক্স আদায় সহজ হবে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্যাক্স প্রদানে উৎসাহিত হবে।
আমার মনে হয় দীর্ঘমেয়াদে সরকারের এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে। মান নিশ্চিতের জন্য বাজেট রাখা প্রয়োজন। প্রতিটি সেক্টরে মান নিয়ন্ত্রনে সরকারের একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা কাজ করবে। এই বিধিবদ্ধ সংস্থা বিভিন্ন ফরম্যাটে কাজ করতে পারে। যেমন: ৬৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকার কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। কিন্তু দেশের মানুষ এখন আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করাতে চাইছে না। এই সংস্থা প্রাথমিক স্কুলের মান জনগণের সন্তুষ্টি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করবে। এজন্য যদি কিছু স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়। তাহলে তাই করবে। মান নিশ্চিতকরণ সংস্থার জন্য সরকারের বিশেষ বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। সময়ক্ষেপন না করে এর মাধ্যমে সেবাখাতগুলোতে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে জনবান্ধব সরকার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা খুব সহজ হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment