ঢাকায় কিশোরদের গ্যাং কালচার
সংবাদ বাংলা: কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আটক করার পর মিডিয়ার সামনে হাজির করেছে র্যাব বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকার উত্তরায় স্কুল পড়ুয়া এক কিশোর আদনান কবীরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর কিশোরদের গ্যাং সম্পর্কিত নানা তথ্য সামনে এসেছে। মুখে সবে দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে। পাওয়ার বয়েজ, ডার্ক শ্যাডো, নাইন স্টার এমন আরো অনেক স্টাইলিশ নাম নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। এমন ফিল্মি সব নাম হলেও এদের কার্যক্রম অতটা সরল নয়। তারা মাদকের সাথে কিছুটা জড়িত। আবার পাড়া মহল্লায় বিভিন্ন যায়গায় লম্বা সময় ধরে বসে থেকে ইভ টিজিং করে। এদের সাথে চলতে চলতে ভালো ছেলেরাও অপরাধে ঝুঁকে পড়ে।
উত্তরার ঘটনাটি ঘটেছিলো গত মাসের ছয় তারিখ। কিশোর আদনান কবীরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর কিশোরদের এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আলোচনার ঝড় ওঠে। বনশ্রীর বাসিন্দা দুই যমজ ছেলের মা লীনা পারভীন বলছেন, ঘটনাটি জানার পর কর্মজীবী মা হিসেবে তিনি খুবই বিচলিত বোধ করছেন। আমি কর্মজীবী। সেই সকালে যাই আর সন্ধ্যায় আসি। এই সময়টা তারা কী করে, কার সাথে মেশে সেটা জানার আমার কোন উপায় নেই। এই বয়সী বাচ্চারাও যে গ্রুপিং বা পেশীশক্তির ধারণায় চলে যাচ্ছে এটা উত্তরার ঘটনাই আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পুরো অজানা একটা বিষয়ের সাথে আমার পরিচয় হলো”, বলছিলেন তিনি।
উত্তরার একজন বাসিন্দা বলছেন, ফ্রেন্ডের সাথে বিবাদ মারামারি বা অস্ত্র পর্যন্ত কেন যাবে? কেন সেটা মৌখিকভাবে শেষ করা যায় না? এটা ভেবে দেখার বিষয় আসলে! তিনি জানালেন তার ১৩ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে উদ্বেগে তিনি তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছেন। এই যুগের ছেলে-পেলেদের হাতের মুঠোয় থাকে ইন্টারনেট। তারা কী ধরনের সাইটে যায় সেটি ল্যাপটপ হিস্ট্রি দেখি। যেসব বন্ধুরা বাসায় আসে বা যেসব ফ্যামিলির সাথে ওঠাবসা এগুলো মনিটর করি। ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’ নামে সক্রিয় এসব কিশোর শুরুতে মূলত ‘পার্টি’ করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো ও রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে যুক্ত ছিল। বছর খানেক ধরে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িত হয়েছে, যার সর্বশেষ শিকার উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। এসব কিশোর এতটাই বেপরোয়া যে আদনানকে হত্যার জন্য বের হওয়ার আগে তারা ফেসবুকে গ্রুপ ছবি পোস্ট করে যায়। ছবিতে তাদের সবাইকে নীল রঙের পোশাকে দেখা গেছে। কারও কারও হাতে ছিল হকিস্টিক। আদনানের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর এক কিশোর পাল্টা স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ভাই তোর খুনিগো বাইর কইরা জবাই দিমু’।
এসব কিশোর অপরাধী ‘গ্যাংয়ের’ ব্যাপারে তাদের অভিভাবক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাই ছিলেন উদাসীন। উত্তরার ১৯ নম্বর সেক্টরের একাধিক বাসিন্দা বলেছেন, বছর দুয়েক ধরে তাঁরা এসব কিশোর বখাটের উৎপাত দেখে আসছেন। তাদের উচ্চগতির মোটরসাইকেলের রেস পথচারীদের আতঙ্কের কারণ ছিল। নিহত আদনান কবিরের বাবা কবির হোসেন উত্তরা পশ্চিম থানায় যে মামলা করেছেন, তাতেও ছেলের খুনের কারণ হিসেবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ‘গ্রুপিংয়ের’ কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও আদনান কোনো ‘গ্যাংয়ের’ সদস্য ছিল না বলে দাবি করেন তার বাবা।
উত্তরার ডিসকো বয়েজের ফেসবুকে (ফেসবুক আইডি—ডিসকো বয়েজ উত্তরা) নিজেদের পরিচয় দিয়ে ‘গ্যাংস্টার’ হিসেবে। এই গ্রুপের প্রধান হলেন ছোটন খান। উত্তরার বাসিন্দা হলেও অন্য এলাকার একটি কলেজে ভর্তি হয়ে আছেন ছোটন। এলাকার লোকজন তাঁকে ছিনতাইকারী হিসেবেও জানে। দুই গ্রুপের দুই প্রধান কারও শিক্ষাগতযোগ্যতা কিশোরদের আকৃষ্ট করার মতো নয়। তারপরও উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা হাইস্কুল, নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ উত্তরা এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁদের দাপট রয়েছে। উত্তরার তিনটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ‘গ্যাং কালচারের’ শুরু কমপক্ষে দুই বছর আগে। শুরুর ‘ডিসকো বয়েজ উত্তরা’ নামে একটি দল ছিল। পরে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে ‘নাইন স্টার’ নামে আরেক গ্যাং তৈরি হয়। এর বাইরে উত্তরায় এলাকায় ছোট ছোট আরও কয়েকটি গ্রুপ পাড়াভিত্তিক সক্রিয় আছে।
দুই দলের সংঘর্ষের চতুর্থ ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ‘নাইন স্টার’ গ্রুপের প্রধান রাজু ওরফে তালাচাবি রাজু (২০)। তাঁকে ছুরিকাহত করে প্রতিপক্ষ। ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিল নাফিস মো. আলম ওরফে ডন নামে এক কিশোর। কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পায় সে। সর্বশেষ আদনান হত্যার মামলায় নাফিসকে আবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদনান খুনের মামলার এজাহারভুক্ত নয়জন আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ।
উত্তরা ট্রাস্ট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরদের বাসা ১২ নম্বর সেক্টরে। সে গত শুক্রবার বিকেলে ১৩ নম্বরে সেক্টরে খেলতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ পর পরিবার জানতে পারে সে খুন হয়েছে। আদনান সেদিন অ্যাডিডাসের যে কালো ব্যাগটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, তিন দিন ধরে সেই ব্যাগ বুকে চেপে বসে আছেন মা কাওসারা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ব্যাগ নিয়েই বেরিয়েছিল। সোয়েটার ছিল ভেতরে। নতুন ব্যাগ। এটা দিয়ে শুধু দুটো কোপ ঠেকাতে পেরেছে। ওরা আমার ছেলের মাথার পেছনে হকিস্টিক দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। পড়ে যাওয়ার পর কুপিয়েছে। হাতের রগ কেটে ফেলেছে। স্ক্রু দিয়ে ছিদ্র করেছে পেট। মাংস খুবলে নিয়েছে। না জানি কতবার মা মা বলে ডেকেছে আমার বাচ্চাটা।’
কিশোর-তরুণদের এভাবে বখে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে এই গ্যাং কালচার তৈরি হতে দেখা গেছে, যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় জুভেনাইল সাবকালচার। অনেক সময় বঞ্চনা থেকে কিশোরদের মধ্যে এমন দল গড়ে ওঠে। আবার কোথাও কোথাও বীরত্ব দেখাতেও ছেলেরা “মাস্তানি”তে যুক্ত হয়। পাড়ায়-মহল্লায় আগেও এমনটা হতো। এখন সেটার সহিংস রূপ দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, খেলার মাঠে বা ছোটখাটো ঘটনায় কিশোরদের মধ্যে ঝগড়া হয়। কিন্তু সেটা যাতে সহিংসতার দিকে না যায়, সে ব্যাপারে এলাকার মুরব্বি ও অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিশোর-তরুণদের গঠনমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত করতে হবে।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment