ঢাকা অভিযান
রহস্যময় নগরী ঢাকা। হাজারো অলিগলি এর। আর সেই অলিগলির আড়ালে লুকিয়ে আছে বিচিত্র জীবন আর জীবনের জটিলতার কাহিনী। নানা কথা, উপকথা, কিংবদন্তি রয়েছে এ ঢাকা শহরের। প্রাচীন ঢাকার বহু কিংবদন্তি আজ আধুনিক ঢাকার বর্ণাঢ্য নির্মাণের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছে সেই জীর্ণ দেয়ালের স্মৃতি। আজকের আধুনিক মেগা সিটি ঢাকার পুরনো শহরের অলিগলিতে খুঁজে পাওয়া যায় স্মৃতি-বিস্মৃতির অনেক উপাদান। তবে সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ঢাকা।
সুবেদার ইসলাম খা যখন ঢাকার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন তখন ঢাকা ছিল ছোট একটি গঞ্জ। সুবেদার শায়েস্তা খার আমলের উত্তরে টঙ্গী থেকে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত ৪৭-৪৮ বর্গমাইলব্যাপী এ মহানগরীতে জনবসতি ছিল ১৬ লাখ। আর নবাব স্যার সলিমুল্লাহ যখন সরদার প্রথার প্রবর্তন ঘটান তখন ঢাকা শহরের পরিধি ছিল পূর্ব-পশ্চিমে বড়জোর তিন মাইল। পশ্চিম দিকে এনায়েতগঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে ধোলাইখাল। অন্যদিকে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উত্তরে এক অথবা বড়জোর দেড় মাইল পর্যন্ত ছিল নাগরিক জনবসতি। তারপরও যে সব এলাকা অর্ন্তভুক্ত ছিল যেমন তেজগাও, শিবপুর (পরে মিরপুর) এগুলো ছিল নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত। কিন্তু এখনকার ঢাকার চারদিকের আয়তন বেড়েছে এরসঙ্গে বেড়েছে জনসংখ্যা।
একসময় বুড়িগঙ্গা নদীর উৎস হতে একটি খাল বাবুবাজার থেকে শুরু করে জিন্দাবাহারের উত্তর দিক হয়ে তাতীবাজারের পাশ দিয়ে গোয়ালনগর তারপর নবাবপুর, মুহসেন্দী ও নারিন্দা রোডের সম্মুখ দিয়ে ঘুরে শরাফতগঞ্জ হয়ে বর্তমান লোহারপুল (এখন পুল নেই) নিচ দিয়ে আবার বুড়িগঙ্গায় মিলিত হয়েছিল। তার বেশিরভাগ অংশ ধোলাইখাল নামে পরিচিত ছিল। ঢাকা ঘিরে এমন অনেক খাল একসময় ছিল। তা এখন নেই। প্রাচীন নগরী ঢাকা’র ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ‘ঢাকা অভিযান’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সাংবাদিক ও গবেষক এম মামুন হোসেন।
ঢাকা প্রকাশ
‘ঢাকা প্রকাশ’ ঢাকার প্রথম বাংলা সংবাদপত্র। এর প্রথম সংখ্যা ১৮৬১ সালের ৭ মার্চ বাবুবাজারের ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ থেকে প্রকাশিত হয়। এটি প্রায় ১০০ বছর টিকে ছিল। ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ঢাকা প্রকাশ ছাড়া রচনা করা সম্ভব নয়। ঢাকা প্রকাশের প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের পর দীননাথ সেনের পরিচালনায় পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ব্রাহ্মধর্মের অনুসারীদের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হলেও মালিকানা পরিবর্তনের সঙ্গেসঙ্গে এটির চরিত্রেরও পরিবর্তন হয়েছে। আর এ কারণেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে টিকে থাকা পত্রিকাও ছিল ঢাকা প্রকাশ। পত্রিকার শিরোনামের নিচে একটি সংস্কৃত শ্লোকাংশ ‘সিদ্ধিঃ সাধ্যে সমামস্তÍ’ (সাধ্য অনুযায়ী সিদ্ধিলাভ হোক) মুদ্রিত হতো। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বের হতো। ডাকমাশুলসহ পত্রিকার বার্ষিক মূল্য ছিল ৫ টাকা। প্রথম দিকে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার বাঁদিকে থাকত বিজ্ঞাপন, ডানদিকে সম্পাদকীয় বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও খবর বা বিশেষ কোনও বিষয়ের ওপর পত্রিকার নিজস্ব মতামত। পরে থাকত ‘সম্বাদাবলী’। এ বিভাগে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে সংগৃহীত বা নিজেদের সংগৃহীত সংবাদ ছাপা হতো। পত্রিকার তৃতীয় পৃষ্ঠায় কখনও বা শেষ পৃষ্ঠায় পাঠকদের চিঠিপত্র ছাপা হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে, ঢাকা প্রকাশের সর্বশেষ সংখ্যাটি ১৯৫৯ সালের ৪ এপ্রিল। আবদুর রশীদ খান সম্পাদিত ৫৯/৩ কিতাব মঞ্জিল, ইসলামপুর থেকে প্রকাশিত।
নকশি রুটি
পবিত্র লাইলাতুল বরাত সৌভাগ্যের রজনী হিসেবে পরিচিত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইবাদতের মধ্য দিয়ে রাতটি পার করে। সেই আদিকাল থেকেই বিশেষ মর্যাদায় শবে বরাত পালন করে পুরান ঢাকাবাসী। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অংশ শবে বরাতের আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা আনন্দময়। তারাবাতি, আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানোসহ পুরো ঢাকা শহর সেজে ওঠে আলোকসজ্জায়। আর এই উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে রুটি-হালুয়া। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ‘নকশি রুটি’। এই রুটি ‘রুমালি রুটি’ বা ‘শবেবরাতি রুটি’ নামেও পরিচিত।
এই ভূ-খÐে ১৯শ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাবদের হাত ধরে শবে বরাত পালনের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। নবাবরা বেশ ঘটা করেই শবে বরাত পালন করতেন। সে সময়ে আলোকসজ্জা করা হতো। পাশপাশি মিষ্টি বিতরণ করা হতো। এখন বাংলাদেশে শবে বরাত পালন ধর্ম এবং সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
প্রতিবছর পুরান ঢাকার অলিগলিতে বিভিন্ন ধরনের রুটির পসরা সাজিয়ে বসেছে ব্যবসায়ীরা। নানা নকশাখচিত একেকটি রুটিতে উৎসবের আমেজের পাশাপাশি ফুঁটে উঠে জনপদটির সহজ-সরল জীবনযাপনের চিত্রও। সেগুলোর কোনোটা দেখতে কুলার মতো, কোনোটা মাছের মতো, আবার কোনোটা কুমিরের মতো। এছাড়া গোলাকার ও নকশা করা এবং ফুলের আকৃতিতে বানানো অসংখ্য নকশার রুটির দেখা যায় দোকানগুলোতে। রুটির গায়ে কাচ বা পুঁতি বসিয়ে সাজানো হয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই ঐতিহ্য ধরেই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে এই নকশা রুটি। শবে বরাতে এই রুটি আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আদান-প্রদান করা হয়। বিশেষ করে শ্বশুর-শাশুড়িরা তার মেয়ে-জামাই বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই রুটি পাঠান।
একসময় শবে বরাতের সব আয়োজন চকবাজারকেন্দ্রিক ছিল। চকবাজার বড় মসজিদের সামনে বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসতেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির পুরনো ঢাকার প্রতিটি এলাকাই এই রুটি বিক্রির দোকানের দেখা মিলবে। বিশেষ করে সাতরওজা এলাকার আনন্দ বেকারি, চকবাজারের বোম্বে সুইটস অ্যান্ড কাবাব, রায়সাহেব বাজার এলাকার ইউসুফ বেকারি, বংশালের আল-রাজ্জাক কনফেকশনারি, ইসলামপুরের কুসুম বেকারিসহ সব বেকারির বিশেষ আয়োজন চোখে পড়ার মতো। রায়সাহেব বাজার, বেচারাম দেউড়ি, নাজিরাবাজার, কলতাবাজার, নারিন্দা, বেগমগঞ্জ, চকবাজারসহ পুরো পুরান ঢাকায় একই দৃশ্য দেখা যায়।
এই দিনে নতুন পোশাক কেনা ও পরার চল রয়েছে। পুরান ঢাকার প্রতিটি মসজিদে মসজিদে শিন্নি বিতরণের জন্য বিরিয়ানি রান্না করা হয়। কোনও কোনও মসজিদে এশার নামাজের পর মোনাজাত করে বিরিয়ানি বিতরণের রেওয়াজ রয়েছে। আবার কোথাও ফজরের নামাজের পর বিরিয়ানি বিতরণ করা হয়। মসজিদ বা এলাকায় পরদিন আসরের নামাজের পর স্থানীয় কবরস্থানে বিশেষ মিলাদ মাহফিল ও মোনাজাত শেষে তবারক বিতরণের রেওয়াজ দেখা যায়।
বজরা হোটেল
তখন নৌপথে যাতায়াত ও ব্যবসা বাণিজ্য চলত। লঞ্চ বা স্টিমার চলাচলের আগেও ঢাকার সদরঘাট এবং সংলগ্ন ওয়াইজঘাট ও বাদামতলী এলাকা থেকে যাত্রীবাহী নৌকা ও মালবাহী নৌকা চলাচল করত। ঢাকায় আগত যাত্রীরা নিজ বাড়িতেই তৈরি খাবার কলা পাতায় মুড়িয়ে কিংবা চিড়া-মুড়ি-গুড় দিয়ে খাবার খেতেন। অবস্থাভাবপন্নরা নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে একটু দূরের হোটেলগুলোতে খাবার খেতেন। ব্যয়বহুল ও গমনাগমনের অসুবিধা লাঘবে বুড়িগঙ্গা নদীতে বেশ কিছু ভাসমান হোটেলের যাত্রা শুরু হয়। বজরা নৌকায় স্থাপিত বলে এগুলো বজরা হোটেল নামেই পরিচিতি পায়। প্রথম দিকে পাটাতনের উপর ছোট পাটি বা সতরঞ্জির উপর খাবার পরিবেশন করা হতো। পরবর্তীকালে লম্বা টেবিল ও টুল বিছানো হয়। প্রথমে গ্রাহককে বড় একটা কাঁসার থালা ও পেতলের গøাস দেওয়া হতো। তারপর পাঁচক বামুন চাহিদা মাফিক ভাত, তরকারি, মাছ পরিবেশন করতেন। সাধারণত ভাত মাছ পেতলের পাত্রে, ভাজা মাছ বা ভাজি পেতলের খাঞ্চায় এবং ডাল বা মুড়োঘণ্ট পেতলের বালতিতে থাকত। খাবারের সুনাম ও চাহিদার ভিত্তিতে এ সব হোটেল বেশ রমরমা ছিল। শুধু স্বল্পবিত্ত লোকজনই নয়, মাঝেমধ্যে বিত্তবানরা রুচি বদলের জন্য খাবার আস্বাদনের জন্য বজরা হোটেলে ঢুঁ মারত। দিনের বেলাতে বেশ ব্যস্ত থাকলেও সন্ধ্যার পর গ্রাহকের আনাগোনা কম থাকত। অনেক বজরাতে আবাসনের সুবিধাও বিদ্যমান ছিল। শেষ মাথায় একটা ঝুলন্ত শোচাগার দৃশ্যমান ছিল। আর ¯œানপর্ব সারতে হতো নদীর পানিতে বালতি ফেলে কিংবা ঘাটে গিয়ে সম্পন্ন করতো। বিংশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত বজরা হোটেল দেখা যেত।
বাতিওয়ালা
বাতিওয়ালা ঢাকার বিলুপ্ত পেশাজীবী। এই পেশার ব্যাপক বিকাশকাল উনবিংশ শতকের শেষার্ধে। রাত হলেই ঢাকা তখন ঘুটঘুটে এক অন্ধকার শহর। ঢাকার রাস্তার পাশে কেরোসিনের বাতি জ¦ালানো শুরু হয় ১৮৭৭ সালে। হঠাৎ করেই ঢাকা শহরে এক নতুন পেশাদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। বাতিওয়ালারা প্রতি সন্ধ্যায় মই বেয়ে ল্যাম্পপোস্টে উঠে সঙ্গে আনা কেরোসিন ভরে সেগুলোতে আলো জ¦ালিয়ে দিয়ে যেত।
বিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই পেশাজীবীদের কর্মব্যস্ততা ছিল। তারপরই এই পেশা দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়েছে। ঢাকার শেষ বাতিওয়ালার নাম দক্ষিণারঞ্জন রাউত। ঢাকা পৌরসভার তত্ত¡াবধানে শহরের সড়কের পাশে বাতিস্ট্যান্ডে প্রতি সন্ধ্যায় তাকে মইয়ে চড়ে বাতি জ¦ালাতে দেখা যেত। ১৯৫২-১৯৫৩ সালের পরে এই ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর তিনি ওই পেশা থেকে অবসর নেন।
বিরিয়ানি
বিরিয়ানি মোগলদের মাধ্যমে ঢাকায় আসা এক বিশেষ প্রকারের খাবার; সুগন্ধি চাল, ঘি, গরম মশলা এবং গোশত মিশিয়ে রান্না করা হয়। বিরিয়ানি উর্দু শব্দ যা ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি ভাষায় বিরিঞ্জ অর্থ চাল বা ভাত। আর বিরিয়ান অর্থ ভেজে নেওয়া। ভাজা গোশত ও সুগন্ধি চালের সহযোগে তৈরি বিশেষ সুুস্বাদু খাবারটিই বিরিয়ানি নামে পরিচিতি পায়। বিভিন্নতায় বিরিয়ানির নানান রকমফের রয়েছে। কাচ্চি বিরিয়ানি, পাঞ্জাবি মোরগ বিরিয়ানি, কোলকাতা বিরিয়ানি, বিফ বিরিয়ানি, হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি, ভাটকালী বিরিয়ানি, ল²ৌ বিরিয়ানি, মোরাদাবাদী বিরিয়ানি, সিন্ধী বিরিয়ানি উল্লেখযোগ্য। বিরিয়ানির ঢাকাই সংস্করণ তেহারি। আর ঢাকাই বিরিয়ানির নাম উঠলে যে নামটি চলে আসে সেটি হল হাজীর বিরিয়ানি। ১৯৩৯ সালে হাজী গোলাম হোসেন সাহেবের হাত ধরে এই বিরিয়ানির শুরু। জনশ্রæতি আছে, একবার স¤্রাজ্ঞী মমতাজ মোগল সৈন্যদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যারাকে গেলেন। কিন্তু স¤্রাজ্ঞী দেখলেন সৈনিকদের স্বাস্থ্যের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তাই তিনি নির্দেশ দিলেন চাল ও গোশত সমৃদ্ধ এমন একটা পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে যা; সৈনিকদের ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে পারে। মমতাজের আদেশে বাবুর্চি যে খাবারটি তৈরি করলেন; সেটাই আজকের ‘বিরিয়ানি’। সৈনিকদের ভোজনালয় থেকে ভোজন রসিক মোগলদের খাবার টেবিলে আসতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
সাকরাইন
বঙ্গাব্দ বর্ষপঞ্জির নবম মাস পৌষ। এই মাসের শেষ দিন গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের হিসেবে জানুয়ারি মাসের ১৪ অথবা ১৫ তারিখে পড়ে। বাংলায় দিনটি পৌষ সংক্রান্তি এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মকর সংক্রান্তি নামে পরিচিত। সেদিন দিনভর ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রঙবেরঙ ফানুশে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী ঢাকার আকাশ। বাড়ির ছাদে ঘুড়ি উড়ানো হয়। অধিকাংশ সময়ে ‘ভোঁকাট্টা’ অর্থাৎ ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগীতা চলে। একজন অপরজনের ঘুড়ি সুতা কাটার কসরৎ করে। সন্ধ্যার পর পুরনো ঢাকার বাড়ির ছাদগুলোতে বর্ণিল আতশবাজির আলোয় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আগুন মুখে নিয়ে খেলা চলতে থাকে। আকাশে ওড়ে রঙবেরঙের ফানুশ। এরসঙ্গে থাকে নানা রকমের খাবারের আয়োজন। পৌষসংক্রান্তির এই সার্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসব হচ্ছে সাকরাইন। এক কথায় বলা যায় সাকরাইন হচ্ছে ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব। সংস্কৃত শব্দ সংক্রান্তি যা, ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন শব্দে রূপ নিয়েছে। ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, ল²ীবাজার, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, নারিন্দা, নবাবপুর, ওয়ারী, গেÐারিয়া, পোস্তগোলা, হাজারীবাগ, লালবাগ ও এর আশেপাশের এলাকাগুলোতে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে ছোট-বড় সকলেই মেতে উঠে এ উৎসবে। প্রাচীন উৎসবের মধ্যে পুরান ঢাকার সাকরাইন অন্যতম। এটা সমগ্র দেশজুড়ে পালিত না হলেও সাকরাইন ঐক্য এবং বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। শুধু ঢাকাতেই নয়; দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পৌষসংক্রান্তির এই উৎসব পালনের রীতি চালু আছে। নেপালে একে বলে মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান এবং ভারতে মকরসংক্রান্তি।
হালখাতা
হালখাতা শব্দটি শুনলেই চোখে ভাসে মোটা রঙের লালখাতা। বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে ব্যবসায়ীরা হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়; কখনো কখনো সুদৃশ্য কার্ড পাঠিয়ে এই বিশেষ দিনে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানানো হয়। এই উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিস্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দেন। বৈশাখের প্রথম দিনে হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকে হালখাতার উদ্ভব। মোগল স¤্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখে হালখাতা উৎসব শুরু হয়। সেসময় চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত প্রজারা খাজনা পরিশোধ করতেন। পহেলা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর পাশাপাশি করতেন আনন্দ উৎসব। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও দোকানদার বৈশাখের শুরুর দিনে করতেন ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান। নিজ নিজ ধর্মের রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় আচার পালনের মধ্যদিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এটি পালন করে। কালের বিবর্তনে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে এক সময়ের জনপ্রিয় উৎসব হালখাতা। তবে এখনও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা হালখাতার রেওয়াজ ধরে রেখেছেন। বিশেষ করে ঢাকার ল²ীবাজার, শাখারীবাজার, তাঁতীবাজার, ইসলামপুর, চকবাজার, বাবুবাজারের ব্যবসায়ীরা ঘটা করে আয়োজন করে থাকে হালখাতা।
লেখক: এম মামুন হোসেন, সাংবাদিক ও গবেষক
Wow it’s outstanding writing