ঢাকা অভিযান
এম মামুন হোসেন: নানা কথা, উপকথা, কিংবদন্তি রয়েছে এ ঢাকা শহরের। প্রাচীন ঢাকার বহু কিংবদন্তি আজ আধুনিক ঢাকার বর্ণাঢ্য নির্মাণের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছে সেই জীর্ণ দেয়ালের স্মৃতি হাতরে প্রাচীন এই নগরীর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে সাংবাদিক ও গবেষক এম মামুন হোসেন এর ‘ঢাকা অভিযান’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব আজ।
আইবুড়ো ভাত
বাঙালি বিয়ের অনেকগুলো অনুষ্ঠানের মধ্যে বলা যেতে পারে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হল আইবুড়ো ভাত। আইবুড়ো কথাটির অর্থ হল অবিবাহিত। বিবাহযোগ্য অবিবাহিত ছেলে বা মেয়েকে আইবুড়ো বলা হয়ে থাকে। ঢাকায় প্রচলিত একটি বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠান যা বিয়ের ঠিক আগের দিন পাত্র ও পাত্রীর বাড়িতে আলাদা আলাদাভাবে হতো। এই অনুষ্ঠানের অর্থ হল বিয়ের আগের শেষ অবিবাহিত অবস্থায় খাওয়া। একটি বড় থালায় নানা উপাদেয় খাদ্য থাকত। অনুষ্ঠানে প্রথমে বর বা কনের মুখে খাবার তুলে দিয়ে অন্যরা গোল হয়ে বসে খেত। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি তার বাপের বাড়িতে শেষ আনুষ্ঠানিক খাওয়া। ভাত যেহেতু আমাদের বাঙালীদের প্রধান খাবার তাই বিয়ের ক্ষেত্রেও খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠানটি প্রধানত ভাতকেন্দ্রিক। নিয়ম ছিলো বিয়ের আগের দিন নিজের বাড়ি আইবুড়ো ভাত খাওয়ার পর আর বাড়ির বাইরে কিছু খেতে নেই বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত।
বাহাদুর শাহ পার্ক
ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে মুগল সম্রাট বাহাদুর শাহ স্মরণে পার্কের পুনঃনামকরণ করা হয়। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে নওয়াব স্যার আব্দুল গণির উদ্যোগে ঢাকার সদরঘাট এলাকায় ‘আন্টাঘর’ নামের একটি আর্মেনীয় ক্লাবঘরের ধ্বংসাবশেষের উপর পার্কটি তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় ওই ক্লাবের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক আর্মেনীয়দের বসবাস ছিলো। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ভিক্টোরিয়া পার্ক বিশেষ পরিচিতি পায়। এখানে একজন মহিলাসহ কয়েকজন সিপাহী বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৮৫৮ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার বিপুলসংখ্যক মানুষের এক সমাবেশে রানী ভিক্টোরিয়ার বিখ্যাত ঘোষণা পাঠ করেন। লোহার রেলিং ঘেরা ডিম্বাকৃতি এই পার্কের ভিতরে চারটি ব্রিটিশ কামান বসানো হয়। সিপাহী বিদ্রোহের পর দীর্ঘকাল পর্যন্ত পার্কটি ছিল জনহীন এলাকা। দিনের বেলায়ও সেখানে লোকজন আসতে ভয় পেত। ১৯৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের (ডিআইটি) উদ্যোগে এই স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
শিক্ষার বাতিঘর লক্ষ্মীবাজার
শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশে নয়; সারা পৃথিবীতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজার। উপমহাদেশে এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এই এলাকায়। শিক্ষা বিস্তারে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে রয়েছে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গৌরর্বোজ্জ্বল ইতিহাস। লক্ষ্মীবাজারের ১০০ গজ এলাকার মধ্যে রয়েছে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, দুইটি সরকারি স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কলেজ, তিনটি সরকারি মাধ্যমিক বালক স্কুল, একটি সরকারি বালিকা স্কুল, ছয়টি বেসরকারি স্কুল, একটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, একটি ল’ কলেজ এবং ডজনখানেক কিন্ডারগার্টেন ছাড়াও আছে দুইটি ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল স্কুল। এখানে অবস্থিত শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (অধুনা জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা ১৮৮৪), ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল (১৮৩৫), পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ (১৮৪৮), কে এল জুবলি স্কুল অ্যান্ড কলেজ (১৮৬৬), সরকারি মুসলিম হাইস্কুল (১৮৭৪), সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল (১৮৮২), সরকারি কবি নজরুল কলেজ (১৮৭৪), সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গালর্স হাইস্কুল (১৯৯২)। এ এলাকা থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা কলেজ (১৮৩৭) ও নটর ডেম কলেজের। পরে কলেজ দুইটি স্থানান্তর করে বর্তমান স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশের প্রথম সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ও প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পোগোজ স্কুল এই এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৮৪ সালে ব্রাক্ষ্ম স্কুল হিসেবে যাত্রা করেছিল। লক্ষ্মীবাজার এলাকাটি আগে মিয়া সাহেবের ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৭৩০ সালের দিকে কাশ্মির থেকে মিয়া সাহেব আবদুর রহিম রিজভী এখানে এসে বসতি স্থাপন করে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৪৫ সালে তার মৃত্যুর পর এখানেই তাঁর মাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে এই এলাকাটি মিয়া সাহেব ময়দান নামেই পরিচিত হয়ে এসেছে। পলাশির যুদ্ধের পর ভিকান ঠাকুর নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কোম্পানির কাজ পরিচালনা করতেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কেম্পানির একজন বিশ্বস্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি কোম্পানির দেওয়ানি পদ লাভ করেছিলেন। এলাকায় লক্ষ্মী নারায়নের মন্দির স্থাপন করেন। পরে তারই প্রচেষ্টায় ইংরেজদের সহায়তায় ১৮৯০ সালে মিয়া সাহেব ময়দান এলাকাটি লক্ষ্মীদেবীর নামানুসারে নামকরণ করা হয় লক্ষ্মীবাজার।
শিল্প সাহিত্যের আতুরঘর বিউটি বোর্ডিং
পুরনো ঢাকার বাংলাবাজারে ঢুকেই শ্রীশ দাস লেনে মোড় নিলেই চোখে পড়বে ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকা বিউটি বোর্ডিং। এই বিউটি বোর্ডিং বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার একটি কেন্দ্র বা ইতিহাসের ভিত্তিভ‚মি। এখানে এসে দাড়াতেই একটি জ্যান্ত ইতিহাসের খোঁজ মেলে। পুরনো দিনের ঢাকার আড্ডার মধ্যে নামকরা ছিল বিউটি বোর্ডিং। তৎকালীন তরুণ এবং আজকের খ্যাতিমান যারা তারা সবাই তখন বিউটি বোর্ডিংকেন্দ্রিক আড্ডাবাজ ছিলেন। বিউটি বোর্ডিং ও এর আড্ডার ইতিহাস চল্লিশের দশক থেকেই ঢাকার সুখ্যাতি লাভ করেছিল। সমমনা লোকদের তখন বিভিন্ন বিষয়ে চলতো তোলপাড় করা সব আড্ডা। অনেক কবি-সাহিত্যিকেরই এভাবে লেখা তৈরির বহু ইতিহাস রয়েছে এই বিউটি বোর্ডিংয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই কোনো না কোনো রেস্তরা পাওয়া যাবে যা লেখক-শিল্পীদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। বর্তমানে শাহবাগ, ঢাকার বাইরে কুমিল্লার দাদার রেস্তরা, চট্টগ্রামের মোমিন রোডের চায়ের দোকান, ময়মনসিংহের তাজমহল হোটেলের আড্ডা, নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিন, চাঁদপুরের কৃষ্ট ক্যাফে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন। সারাদেশ খুঁজলে এমন বহু আড্ডার জায়গা পাওয়া যাবে। কিন্তু বিউটি বোর্ডিংয়ের বিশেষত্ব ছিল আলাদা। এখানে যারা আড্ডা দিতেন তারা ছিলেন সৃষ্টিশীল। কারো কারো হাত দিয়ে কালি নয়, ঝরতো রক্ত আর সৃষ্টি হতো বিখ্যাত সব কবিতা কিংবা উপন্যাস। এখানেই বসে তৈরি হতো রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রস্তুতি কিংবা মননশীলতার চর্চা। বিউটি বোর্ডিংয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অজস্র কারণ ছিল। এই বিউটি বোর্ডিংয়ের জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন এ দেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্র পরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বসেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনের সভা করেছেন, দিয়েছেন বিভিন্ন দিকনির্দেশনা। তবে এখনকার জমজমাট আড্ডার প্রাণপুরুষ ছিলেন কবি শহীদ কাদরী ও বেলাল চৌধুরী। দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এখানে বসে সকাল-সন্ধ্যা আড্ডা দিতেন। এখানে বসেই জন্ম দিতেন তাদের বিখ্যাত সব লেখার। এছাড়াও এখানকার আড্ডা মাতাতেন খালেদ চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সঞ্জীব দত্ত, ফজলে লোহানী, ফতেহ লোহানী। আসতেন বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। আসতেন হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ইংলিশ চ্যানেল পার করা ব্রজেন দাশ। খোয়াবনামা’র স্রষ্টা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমদ ছফা, হায়াৎ মামুদ, অমর সুরকার সত্য সাহা, সাদেক খান, এনায়েত উল্লাহ খান, কবি আল মাহমুদ, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কবি নির্মলেন্দু গুণ, জাদু সম্রাট জুয়েল আইচ প্রমুখ। শামসুর রাহমান এখানে বসেই লেখেন তার বিখ্যাত সব কবিতা। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার সেরা রচনাগুলো এখানে বসেই লেখা। বিউটি বোর্ডিংয়ের সেই তুমুল আড্ডায় ছেদ পড়ে ১৯৭১ সালে। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানি শোষকরা খবর পায়, বিউটি বোর্ডিং বাংলাদেশের মেধাবীদের সর্ববৃহৎ আড্ডা। অতঃপর হামলা। ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিং ঘিরে ফেলা হয় এবং মালিক প্রহ্লাদ সাহা, বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার-বোর্ডারসহ প্রায় ১৭ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাক সেনারা। এখনো বিউটি বোর্ডিং আছে। আছে ২৪টি কক্ষ। এর মধ্যে সিঙ্গেল কক্ষ ৮টি। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া ৭৫ টাকা। ডাবল কক্ষ রয়েছে ১৫টি। প্রতিটির ভাড়া ১৪০ টাকা। তিনবেলাই খাবার ব্যবস্থা আছে। ক্যান্টিনে তৈরি অনেক মুখরোচক খাবারই ছিল অনেকের প্রিয় খাবার তালিকায়।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment