Sangbad Bangla 24

News

 শিরোনাম
  • সোনার দামে নতুন রেকর্ড, ভরি ১৩৫৬৬৪ টাকা সংবাদ বাংলা: সোনার দামে নতুন রেকর্ড করেছে। ভরি ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬৪ টাকা। সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করল। আগামীকাল বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে বলে...
  • পদ্মায় মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর পরিব্রাজক ফোরামের নৌভ্রমণ চাষী সিরাজুল ইসলাম: পদ্মায় মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর পরিব্রাজক ফোরামের নৌভ্রমণ নিয়ে কিছু কথা। গত ১৮ মার্চ ময়ূরপঙ্খি নাওয়ে পদ্মা ভ্রমণের সুখস্মৃতি। সকাল পৌনে সাতটায় ধানমন্ডি থেকে বাসে চেপে বসলাম। গুলিস্তানে এসে...
  • জবি অ্যাকাউন্টিং অ্যালামনাই কমিটির চতুর্থ সভা অনুষ্ঠিত সংবাদ বাংলা: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটির চতুর্থ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় জবির অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সেমিনার কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি কামরুল হাসান রিপনের...
  • মীরপুরে এক বেলা আহারের শীতবস্ত্র বিতরণ সংবাদ বাংলা: শীত বস্ত্র বিতরণ করেছে ‘এক বেলা আহার’ সংগঠন। শনিবার  মীরপুরে শরীফ শিক্ষা পরিবার স্কুলের ১৬০ জন শিক্ষার্থীর মাঝে  শীতবস্ত্র, কলম ও খাতা বিতরণ করা হয়। এসময় এলাকার বিশিষ্টজন...
  • এক বেলা আহারের শীত বস্ত্র বিতরণ সংবাদ বাংলা: প্রতিবন্ধী ২১৪ পরিবারের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ করেছে সেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এক বেলা আহার’। শনিবার সাভারের গান্দারিয়া গ্রামে এই শীত বস্ত্র বিতরণ করা হয়। এই গ্রামে ২১৪টি প্রতিবন্ধী পরিবার...

তুপা (ধারাবাহিক উপন্যাস)—এম মামুন হোসেন

তুপা (ধারাবাহিক উপন্যাস)—এম মামুন হোসেন
এপ্রিল ০৫
০১:০২ ২০১৯

১.
সারারাত বিড়ালের কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছেন মনোয়ারা বেগম। তিনি ভেবেই বসে আছেন আজ কোনো একটি দুর্ঘটনা ঘটবে। আর সেই চিন্তায় তিনি অস্থির। এত বেলা হয়েছে এখনো তিনি কোনো খাবার মুখে দেননি। নাস্তা খাওয়ার জন্য কয়েকবার ডাকাডাকি করেও যখন তাকে নাস্তা করানো যায়নি; তখন সবাই ভেবে বসেছে তিনি রাগ করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার এরকম নাস্তা ত্যাগ করার কারন জানতে পেয়ে অনেকে হাসতে গিয়েও হাসলো না, পাছে সত্যি সত্যি তিনি রাগ করে বসেন।
হাসানকে বাড়ী থেকে বের হতে দেখে তার মা মনোয়ারা বেগম গতকাল রাতের বিড়ালের কান্নার শব্দের কথা জানালেন এবং ভালো করে বলে দিলেন, সাবধানে থাকতে। হাসান কথাটা মোটেও কানে তুলেনি, তার মা খেয়াল করেননি। মাকে তার কিছু কঠিন কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। সে নিজেকে সামলালো। কী দরকারÑএই ভেবে আর কোনো কথা না বলে বাড়ী থেকে বের হল।
রাস্তার পান সিগারেটের দোকান থেকে দু’টো বেনসন অ্যান্ড হ্যাজেজ নিয়ে একটি ধরালো। আরেকটি পকেটে রেখে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে লাগলো। আকাশে সূর্য্যরে তেজ খুব একটা বেশি না। কিন্তু তারপরও রাস্তার চিপ গলে ভ্যপসা একটা গরম ভাব আসছে। হাসান মনে মনে ঠিক করছেÑ কোথায় যাবে? এখন গেলে সজীবকে মেসে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেখানে যেতে ভাল লাগছে না। তুপার কলেজে গেলে কেমন হয়? হঠাৎ যদি দেখতে পায় ওর কলেজের সামনে হাসান দাড়িয়ে আছে। দেখে বেশ অবাক হবে। বলবে, হাসান ভাই আপনি? আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। চলুন আমার সঙ্গে।
এসব ভাবতে ভাবতে তুপার কলেজের সামনে এসে পড়েছে হাসান। মেয়েদের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে তার কিছুটা লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে সবাই তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কলেজ ছুটি হয়েছে। একে একে সবাই বের হচ্ছে। তুপাও এখন বের হবে। শেষ মেয়েটি বের হওয়া পর্যন্ত হাসান ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তুপা, বের হয়নি। বোধ হয় তুপা কলেজে আসেনি। তুপা, আজ কলেজে আসেনি। কেন আসেনি? কী হয়েছে? শরীর-টরির খারাপ করেনি তো? নাকি ওর বাসায় গিয়ে হাসান উপস্থিত হবে। প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে খেতে হাসানের মাথায় জিলাপির প্যাঁচের মত প্যাঁচাতে থাকল। প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে একেবারে গিট্টু লেগে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে হাসান চায়ের দোকানে ঢুকল। দোকানের সবাই কমবেশি তাকে চিনে। রীতিমত এখানটায় আড্ডা বসে হাসানদের। একটা ছেলেকে ডেকে হাসান বলল, খুব কড়া করে এক কাপ চা দিতে। চায়ের অর্ডার দিয়ে আবারও ব্যাপারগুলো তার মাথায় প্যাঁচতে শুরু করল। প্রায়ই কোন একটা বিষয় নিয়ে হাসানের এমন হয়। বিশেষ করে তুপাকে নিয়ে বড্ড বেশি হয়।
চা এলো। অন্যমনষ্ক ভাবে মুখে চায়ে চুমুক দিতেই ঠোঁটে ছ্যাত করে উঠলো। নিজের উপর হাসানের খুব রাখ হল। আসলেই আজ দিনটা সকাল থেকেই খারাপ যাচ্ছে তার। কাজের কাজ কিছ্ইু হল না। চা খেতে গিয়ে ঠোঁট পুড়ল। চা শেষ করেই হাসান সজীবের মেসে গেল। কিন্তু সেখানে সজীব নেই। তার রুমগেট রকিব ছিল।
‘হাসান, কেমন আছ?’
‘ভাল। আপনি কেমন আছেন?’
‘আছি, তা অনেকদিন পরে আসলে,’
‘আমি মাঝেমাঝেই আসি, আপনি তখন থাকেন না। সজীব কখন আসবে কিছু বলতে পারবেন?
জুতা পরতে পরতে রকিব বলল, ঠিক বলতে পারবনা। তবে আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে। তুমি বরং থাকো। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। হাসান একবার ভাবল বলবে, না আজ চলে যাই। কিন্তু কিছু বলল না। রকিব চলে গেল। হাসান দরজা ভিড়িয়ে সজীবের নড়বড়ে চৌকিতে শুয়ে পড়ল।
সজীবের রুমে দুটি চৌকি পাতা। চৌকি আর খাটের মধ্যে বড় পার্থক্য আছে। চৌকি হচ্ছে চার বা ছয় পায়ে দাড়ানো নকশাবিহীন সমান্তরাল কাঠে বানানো। মেস জীবনে এই চৌকির বেশ কদর। একটা চৌকিতে রকিব আর অন্যটায় সজীব থাকে। একটা আলনা। মাথার উপর একটা সিলিং ফ্যান। তবে ফ্যানটায় বাতাসের চেয়ে শব্দ হয় বেশি। সজীবের গ্রামের বাড়ী কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়। তিন ভাই বোনের মধ্যে সজীব সবার বড়। সজীব গ্রাম থেকে এসএসসি পাস করেছে। বাবা গ্রামের দরিদ্র মানুষ। কিছু জমিজমা চাষাবাদ করে। অর্থ উপার্জনের মাধ্যম জমি। হাইস্কুলের পড়া শেষে কলেজে ভর্তি করাতে তেমন আগ্রহ সজীবের বাবা লাল মিয়ার ছিল না। কিন্তু ছেলে ভাল রেজাল্ট করেছে আর স্কুলের শিক্ষকদের পীড়াপীড়িতে কলেজে ভর্তি করাতে রাজি হন। স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব তার ঢাকার একজন আত্মীয়ের বাড়ীতে সজীবের লজিং থাকার ব্যবস্থা করে দেন। গ্রামের সবার সঙ্গে বিদায় নিয়ে সজীব চলে আসে ঢাকায়, ভর্তি হয় ঢাকা কলেজে। কলেজেই হাসানের সাথে পরিচয়। তারপর বন্ধুত্ব। এভাবে কলেজ জীবন পেরিয়ে একসাথে বিশ্ববিদ্যালয় পাড়। বন্ধুত্ব ঘনিষ্ট ছাড়া একটুও কমেনি।
সজীব দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে হাসান ঘুমাচ্ছে। বিছানার সামনে বসে বেশ কয়েক বার ডাকল হাসান! হাসান! এই হাসান! অনেকক্ষণ পর হাসান চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, সজীব কখন এলি?
‘এইতো এক্ষুনি!’
‘ক’টা বাঁজে?’
‘সাতটা।’

২.
ফিরোজ সাহেবের মা রোকেয়া বেগম জানতে পারলেন তার স্বামী মাহতাব আহমেদ দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সেই ঘরে দুই মেয়ে এক ছেলে হয়েছে। ফিরোজ সাহেব তার বাবার হঠাৎ এমন হতবুদ্ধিতে অবাক হলেন। কিন্তু কোনো কিছু বললেন না। মাহতাব আহমেদের পাঁচ মেয়ে এক ছেলে। সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে মেয়ের ঘরে তার নাতী নাতনী আছে। আর এই বয়েসে গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন তা কেউ মিলাতে পারলেন না। এ নিয়ে রোকেয়া বেগম সারাক্ষণ বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,বুড়ার এই বয়েসে কী বিমরতীতে ধরলÑএই ফিরোজ তোর বাপের এ কি হল? রোকেয়া বেগম তার স্বামীর ভাগ সতীনকে দেওয়ার ব্যপারটা কিছুতেই মানতে পারলেন না। মারা গেলেন। সবাই জানে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু রোকেয়া বেগম আসলে আতœহনন করেছেন। স্ত্রী বিয়োগের পরপর মাহতাব আহমেদ তার কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করতে লাগলেন। একদিন ছেলে ফিরোজকে তার ঘরে ডেকে গেলেন। বাপ ছেলে ঠিক কী নিয়ে আলোচনা করলেন তা কেউ জানেন না। এ পৃথিবীর মায়া আর মাহতাব আহমেদকে ধরে রাখতে পারল না। ছয় মাসের ব্যবধানে বাবা-মা দু’জনকে হারালের ফিরোজ সাহেব। তারপর ফিরোজ সাহেব তার সৎমা মনোয়ারা বেগমকে এ বাড়ীতে নিয়ে এলেন। বসালেন মায়ের আসনে। হাসান ফিরোজের সৎ ভাই কিন্তু তা বাইরে থেকে কারো বোঝার সাধ্য নেই।
হাসানের গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ। কিন্তু তার বড় ভাই ফিরোজ তাকে কাল্লু নামে ডাকে। অন্য কেউ এ নামে তাকে ডাকে না। নামটা হাসানের পছন্দ না। এটা একটা ডাকার নাম হল। কিন্তু ফিরোজ সাহেব এই নামে ডাকলে তার ভাল লাগে। সে সকলের জন্য হাসান কিন্তু দাদার জন্য কাল্লু।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দাদার সাথে হাসানের দেখা হয়না। তার আগেই তিনি ব্যবসার কাজে বের হয়ে যান। ভাদ্র মাসের পাঁচ তারিখ তার বাবা মাহতাব আহমেদের মৃত্যু বার্ষিকী। ফিরোজ সাহেব বাসা থেকে বের হবার আগেই বলে গেছেন। কাল্লু যেন জয়নাল সাহেবের বাসায় গিয়ে দাওয়াত দিয়ে আসে। সারাদিন জয়নাল সাহেব বাসায় থাকেন। রাতের বেলা তার কাজ। তার সব কাজ রাতে হলেও লোক দুই নম্বরি না। দারুন রসিক মানুষ। হাসানকে পছন্দ করেন। হাসান সকাল দশটার দিকে জয়নাল সাহেবের বাসায় পৌঁছল। বগলের কাছ অদ্ধি গোটানো গোলাপী রঙের ফুল হাতা শার্ট আর নীল জিন্সের প্যান্ট পরেছে হাসান। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। এ বাসার এসে দরজার কলিং বেল বাজায় না। একবার সুইস চাপতে গিয়ে বিদ্যুতের ধাক্কা খেয়েছিল। বহুবার তাকে বলা হয়েছে সুইচ ভালো। তারপরও এসে জোরে জোরে দরজা পেটাতে থাকে।
দরজা খুলল কাজের মেয়ে ফুলিমন। গ্রামের মেয়ে। খুব আদব কায়দা ওয়ালা। দরজা খুলেই সঙ্গে সঙ্গে সালাম। দেয় সুন্দর করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। রীতিমত টাসকী লেগে যাওয়ার মত ব্যাপার। হাসান বলল। ফুলিমন কেমন আছ?’
‘জ্বি ভাল।’
‘কাকা বাসায় আছেন।’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানিয়ে ফুলিমন হাসানকে ভিতরে ড্রইংরুমে বসল। এই বাড়ীর একমাত্র মেয়ে অদিতি। দেখতে সুন্দর। মুখের অববয়, ভাসা চোখ। ফিগার অতুলনীয়। সে কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। বিবিএতে পড়ছে। সুন্দরীরা সব বিবিএ করছে। হাল আমলে সবকিছু বাদ দিয়ে বিবিএ পড়া ফ্যাশনে দাড়িয়েছে। কোনো লক্ষ্য নেই; বিবিএ পড়ছে। হাসানকে দেখে অদিতি ড্রইংরুমে ঢুকল। তার মুখে এমন আনন্দের ছটা প্রকাশ পাচ্ছে দেখে মনে হয়, সে জানতো আজ হাসান আসবে।
‘হাসান ভাই, কেমন আছ?’
‘ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?’
‘কেমন আছি তা কী জানার, তোমার সময় আছে? আজ কতদিন পরে এসেছ জান?
হাসান ঠিক কত দিন পর এলো তার মনে নেই। তাই ঠোঁট টেনে শুধু অদিতির দিকে তাকিয়ে হাসল।
‘বলতে পারছনা তো? জানতাম, পারবে না। আচ্ছা, তুমি এমন কেনো বলতো?’
‘তুমি তো যেতে পার।’
‘আমি তো যাই-ই। কিন্তু যার জন্য যাই….। যাক ওসব কথা। তা হঠাৎ কী মনে করে এলে?
‘এমনি। তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?’
‘কলেজে!’
‘যাও তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘হচ্ছে। তবে আজ আর যাবো না।’
হাসান বলতে চেয়েছিলো কেনো যাবেনা? কিন্তু বলতে গিয়েই থেমে গেল। কারণটা হাসান জানে। অদিতি হাসানকে পছন্দ করে। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেকবার তা বুঝানোর চেষ্টা করেছে। হাসান সবই জানে। অদিতি সুন্দরী ভরাট শরীর। উপচে পরা যৌবন। যে কোনো যুবকের হৃদয়ের ষ্পন্দন বন্ধ করার মত শারীরিক গঠন। কিন্তু হাসানের ভালো লাগে না। পিড়িতের পেতœীও সুন্দর। যখনি অদিতিকে দেখে তার মনে তৃষ্ণা জাগে। কামনা জাগে। নগ্ন লালসার দৃষ্টি যেন উপচে পরে। তার মনে হয় অদিতি বিছানার সঙ্গী হতে পারে কিন্তু তার হৃদয়ের নারী হতে পারে না। এগুলো ভেবে হাসানের নিজেরই লজ্জা লাগে। ছিঃ এসব কী ভাবছে? জয়নাল সাহেবকে ঢুকতে দেখে হাসানের ভাবনায় ছেদ পড়লো। হাত উচিয়ে সালাম দিল। বাবাকে দেখে অদিতি ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
‘হাসান কেমন আছ?
‘জ্বি-ভাল’
‘বাড়ীর সবাই ভাল আছে?’
‘জ্বি আছে’
‘তুমি তো এখন আসই না?’
‘আসলে, আসব-আসব করে আসা হয় না।’
‘ঠিক বলেছ। আরবের মানুষ হজ্ব পায়না। হি—–হি—-হি কিন্তু তুমি যদি বিদেশেও থাকতে এই ক’দিনে অন্তত তোমার একটি চিঠি হলেও পেতাম। কী বল ঠিক বলেছি না?’
হাসান মাথা নাড়ে। বেশ জোরে জোরে নাড়ে।
‘অনেক দিন পড়ে এলে। আজ একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাবো। তোমার সঙ্গে দাবা খেলতে বসবো। মনে আছে, গতবার তুমি আমায় হারিয়ে ছিলে।’
‘আজ খেললেও হারবেন।’
‘না আজ জিতবো। তুমি দেখে নিও।’
‘তাহলে চলুন খেলা শুরু করি।’
‘ঠিক আছে। তুমি যদি জিতলে তোমাদের চাইনিজ খাওয়াবো।’ এমনি সময় অদিতি নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকলো। অদিতির দিকে তাকিয়ে বলেন, কী বলিস মা, তোর হাসান ভাই যদি হারে তাহলে কী হবে?
জয়নাল সাহেব দাবার কোট সাজাতে বসলেন। অদিতি তার বাবার প্রশ্নের উত্তর নিা দিয়ে বলল, ‘আব্বু আগে হাসান ভাইকে নাস্তা করতে দাও। তারপর তোমাদের দাবা।’ জয়নাল সাহেব ‘জো আজ্ঞা’ বলেই হি..হি করে হাসতে লাগলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, মা শোন হাসানের সাথে বাজি চলছে। যদি ও জিতে তাহলে তোদের সবাইকে চাইনিজ খাওয়াবো। তোর মাকে ডাক আগে। জলদি ডাক, আজ আমি জিতবই।
‘আব্বু আমি কিন্তু হাসান ভাইয়ের দলে।’
‘মেয়ে বলে কি? হাসান শুনেছে। তোমাকে কিন্তু ও দারুন পছন্দ করে বলেই জয়নাল সাহেব ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলেন।
অদিতি এই কথা শুনে লজ্জা পেয়ে আর খেলা পর্যন্ত হাসানের সামনেই আসেনি। জয়নাল সাহেবের স্ত্রী মরিয়ম বেগম স্বামীর কথা মতো বসে বসে দাবা খেলা দেখেছেন। আর মাঝেমধ্যে উঠে গিয়েছেন রান্না ঘরে। আজ ফুলিমনকে সাথে নিয়ে অদিতি রান্না করছে। আসলে মরিয়ম বেগম দাবা খেলার কিছুই বোঝেন না। চুপচাপ বসে দাবার কোটে তাকিয়ে ছিলেন।
দুপুরের সময় খেলা শেষ হল। হাসান আজো জিতেছে। জয়নাল সাহেব আজ হেরেছেন। তারপরও তিনি খুব খুশি। জহুরের নামাজ শেষ করে হাসানকে নিয়ে জয়নাল সাহেব খেতে বসলেন। অদিতিকে সবার সাথে খেতে বসল না। অদিতি নিজেই বেড়ে বেড়ে খাওয়ালো আজ।
সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব এমন সময় হাসান জয়নাল সাহেবের বাসা থেকে বের হলো। অদিতি আজ হাসানকে তাদের ছাদে নিয়ে গেছে। ছাদের পুরোটাই গোলাপ টবে ভর্তি। গাছে গোলাপ ফুটে চেয়ে আছে। দেখতে অনেক ভাল লাগে। হাসানের চোখে চোখ রেখে অদিতি বলল, হাসান ভাই, আমি তোমাকে ভালবাসার উপরে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে……। কথাটা শেষ করতে পারেনি মেয়েটি। তার দু’চোখ ছলছল করে উঠে।

৩.
প্রচন্ড রোদ উঠেছে। এই রোদে হাটতে কষ্ট হয়। হাটা ছাড়া উপায় নেই। সজীবের একটা ইন্টারভিউ আছে। চাকরিটা তার হবে না, সে একশতে একশত দশ ভাগ নিশ্চিত। তাদের প্রশ্নগুলো ছিল বেশ অদ্ভুত। তারা এসব প্রশ্ন করে দারুন মজা পায়।
‘আপনার নামতো খন্দকার আনিসুর রহমান?’
‘জ্বি’
‘আচ্ছা বলুন তো এটা কী মাস চলছে?
‘বাঙলা মাস বলব, না ইংরেরি মাস।
‘বাঙলা মাসই বলুন। আমরা তো বাঙালি হয়েও বাঙলা মাস ঠিক মতো জানিনা । আরেক জন সুর মিলিয়ে বললেন, বাঙলাই বলুন।
‘ভাদ্র মাস।’
‘এ মাসের আপনার একটি প্রিয় কিছুর নাম বলুন তো?’
‘তালের পিঠা।’
‘আপনার সব রেজাল্টই ভাল। ঠিক আছে আমরা পরে জানাব।’
সজীব জানে এই পর আর আসবে না। কখনো তাকে জানানো হবে না। আর তার চাকরিও হবে না। সে ভেবে পায় না, তাদের এসব প্রশ্নের সাথে চাকরির কী সম্পর্ক। একটার পর একটা চাকরির দরখাস্ত করেই যাচ্ছে। একটার একটা ইন্টারভিউ। যদি মিলে যায়। আরব্য উপন্যাসের আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো চাকরি তো আর সহজেই হাতে আসেনা।
সজীব দুপুরে মেসে ফিরলো না। ফুটপাতের পাশে হোটেল ছালাদিয়া থেকেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। ভাত, ডাল আর পাঙ্গাস মাছের দো পিয়াজা। রান্না খারাপ না। হাসান এসব হোটেলের নাম দিয়েছে দি গ্রেট ইটলিয়ান রেস্টুরেন্ট। পাঁচটা থেকে তার টানা টিউশনি। রাত নয়টা পর্যন্ত টিউশনি চলবে। এই টাকা দিয়ে নিজের ঢাকায় থাকার খরচ। এই থেকে আবার গ্রামেও পাঠাতে হয়। গতকাল একটি চিঠি এসেছে গ্রাম থেকে। চিঠিটা তার বাবা লিখেছেন।
বাবা সজীব,
পত্রে দোয়া রইল। আমরা এখানে কুশলেই আছি। অনেকদিন তোমার কোনো চিঠিপত্র পাইনা, তাই চিন্তায় আছি। তোমার মা গত রাত্রে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। তাই তোমায় চিঠি লিখতে হলো। তুমি কেমন আছ জানাইবা। সেই যে পরীক্ষা শেষে সপ্তাহখানেক এসে থেকে গেলা, আজ কয় মাস হল তুমি বাড়ীতে আসো না। সবই বুঝি। তারপরও বাপ মায়ের মন তো মানে না। তোমার শরীরের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখিও। তোমার ভাই বোনের সালান নিও। তোমার মায়ের দোয়া রইল। আর কী লিখব। পত্রপাঠ উত্তর দিও।
ইতি
তোমার বাবা
লাল মিয়া
চিঠিটা এখনো সজীবের পকেটে। চিঠির উত্তরের সাথে তাকে মানি অর্ডার করে কিছু টাকা পাঠাতে হবে। বাড়ীতে গিয়ে দেখে এসেছে ঘরের চাল ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরে বৃষ্টির পানি পরে। এখনো মাস শেষ হয়নি। তারপরও তাকে কিছু টাকা জোগাড় করতেই হবে।
এখন সজীবের হাঁটতে খারাপ লাগছেনা। রোদ পড়ে গেছে। অদ্ভুত শহর। সবাই ব্যস্ত। কারো সময় নেই। মনের কথা বলে কিছুটা হালকা হবার উপায় এই শহরে নেই। সজীব, মীম নামের একটি মেয়েকে পড়ায়। দারুন বুদ্ধিমতী। ফাইভে পড়া একটি মেয়ে কিন্তু কী অসম্ভব তার বুদ্ধি। সজীবের অবাক লাগে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মীম সজীবের সাথে গল্প করে। সংসারের তি² বাস্তবতার করাল গ্রাসে অতিষ্ট জীবনে মীমের সঙ্গ তার ভালোই লাগে। হাক ছেড়ে বাঁচার একটুকু অবসর।
‘মীম, তোমার পড়া সব মুখস্ত হয়েছে?
‘হয়েছে।’
‘আর কিছু বাকি আছে?’
‘ঊ-হু। স্যার বলুন তো পৃথিবীতে সব চেয়ে বোকা কারা?
‘বলতে পারছি না।’
‘মানুষরা।’
‘মানুষরা?’
‘মানুষরাই সবচেয়ে বোঁকা।’
‘তুমি কী করে বুঝলে।’
‘বলব না।’
‘ কেনো?’
‘এমনি। আপনি রাগ করেছেন।’
‘না। কেনো বলতো?’
‘আমি বলবো না বলে।’
‘না রাগ করিনি। আমি তোমার উপর কখনো রাগ করি না।’
মীমের কথা আসলেই সত্য। পৃথিবীর সব প্রাণীর চেয়ে মানুষই সবচেয়ে বোঁকা। তারা সংসার বাঁধে। ভালবাসে। আশায় বুক বাঁধে। তারপর সব একদিন শেষ হয়ে যায়। জোলাবাত্তি খেলার মত সব শেষ হয়ে যায়। আশা নিরাশায় রূপ নেয়। কেউ পরের খোঁজে ঘর ছেড়ে যায়।

৩ Comments

  1. bijoy
    bijoy এপ্রিল ০৫, ০১:২৮

    পড়লাম। ভালো লাগলো।

    Reply to this comment
  2. sonu
    sonu এপ্রিল ০৫, ০১:২৯

    Waiting for next…

    Reply to this comment
  3. Imu
    Imu আগস্ট ২১, ০০:৫৮

    valo laglo

    Reply to this comment

Write a Comment

Leave a Reply

ফটো গ্যালারি

This slideshow requires JavaScript.

কারবার স্মৃতিতে অনন্য হোসনি দালান

ঢাকাইয়া বনেদি খাবার