দায়িত্ব আসলে কার?
মামুন রশীদ: যেকোনো সম্পর্ক স্থাপনে থাকে দায়িত্ব, দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। আমরা সবাই দায়িত্বশীলতা, দায়বদ্ধতা বা অন্যকে দায়িত্বশীলতার উপদেশ দিলেও, নিজের বেলায় তা মানতে নারাজ। চলতি মাসের শুরুতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল ডেঙ্গু। এডিস মশাবাহিত এই রোগটি রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখন, এই মধ্য আগস্টের পরে এসে রোগটির প্রকোপ যে কমে গেছে, এডিস মশা যে হাওয়ায় উড়ে গেছে বা আর নতুন করে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে না, বিষয়টি মোটেও তা নয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমেনি, বরং তাকে চাপা দিয়েছে ঈদুল আজহায় কোরবানি দেওয়া পশুর চামড়ার বাজার। ঈদের আগে ডেঙ্গু আতঙ্ক যেভাবে ছড়িয়েছিল, যেভাবে ডেঙ্গু রোগীতে হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছিল সহসা সেই আতঙ্ক কমে যাওয়ার মতো আসলে অলৌকিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলছে, এবারে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে রেকর্ড সংখ্যায়। এখন পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি রোগী হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু জ¦র নিয়ে ভর্তি হয়েছে, চিকিৎসাসেবা নিয়েছে। এত বড় একটি সংখ্যার মানুষ যখন একটি রোগে আক্রান্ত হয়, তখন হুট করেই তা কমে যাবে এমনটি আশাও করা যায় না। ডেঙ্গুকে মহামারী হিসেবেই দেখা হয় ঈদের আগ পর্যন্ত। দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর, জ¦রটি প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক ছিল বলেই ধারণা করা হয়েছিল। তবে খুব কম সময়েই সে ধারণায় বাদ সাধে রোগটি। ঈদ উপলক্ষে এবং ঈদের আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেকেই রাজধানীতে আত্মীয়-স্বজনবিহীন অবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাবেন না ভেবে ঢাকা ছাড়েন। এতে রোগটিও রাজধানীর বাইরে এবারই প্রথম বড় পরিসরে তার থাবা বাড়ায়। ডেঙ্গু রোগীদের রাজধানী ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগটিও তাদের সঙ্গী হয়। সারা দেশের মানুষই আক্রান্ত হতে থাকে ডেঙ্গুতে। রাজধানীর মতো দেশের অন্যান্য জেলা শহরের হাসপাতালেও ভিড় বাড়তে থাকে ডেঙ্গু রোগীর।
ডেঙ্গুর সঙ্গে আরও একটি আতঙ্ক এবার মানুষকে পেয়ে বসেছিল, গুজব। তবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কমিয়ে দেয় গুজবের নৃশংসতাকেও। গুজব এবং ডেঙ্গুর আতঙ্কের মাঝেই শুরু হয় মানুষের ঈদযাত্রা। ঈদকে উপলক্ষ করে মানুষ ছাড়তে থাকে রাজধানী। যোগ হয়, নতুন দুর্ভোগ। যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে মহাসড়ক। আগে থেকে যাত্রার টিকেট সংগ্রহ করা থাকলেও, টার্মিনালে গিয়ে মানুষ নির্ধারিত সময়ে দেখা পায়নি যানবাহনের। স্থবির মহাসড়ক পেরিয়ে যানবাহন নির্ধারিত সময়ে পৌঁছতে পারেনি, ফলে পথে যেমন, তেমনি টার্মিনালেও অপেক্ষমাণ মানুষের সংখ্যা বাড়ে। আর দীর্ঘ হতে থাকে সড়কে থমকে থাকা যানবাহনের সংখ্যা। প্রতিবছরই প্রায় নিয়ম করে, উৎসবের সময়ে স্থবির হয়ে পড়ে মহাসড়ক। ঘর ছেড়ে বের হওয়া অতিরিক্ত মানুষের পরিবহনের জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত যানবাহনের। আর সেই চাপ সামাল দিতে, হাজির হয় মহাসড়কে চলার অনুপযোগী অনেক যানবাহন। নিরুপায় সাধারণ মানুষ অনুপোযোগী যানবাহনে চেপে বসে। এতে একদিকে যেমন মহাসড়কে বাড়তি যানবাহনের চাপে স্থবির হয়ে পড়ে, তেমনি বেড়ে যায় দুর্ঘটনার সংখ্যাও। এবারও ঈদযাত্রায় এবং রাজধানীতে ফিরে আসার পথে অসংখ্য যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। অকালে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। ঈদযাত্রা শেষে ফিরতি পথে শুক্রবার মহাসড়কে প্রাণ হারিয়েছে একই পরিবারের পাঁচজনসহ আটজন মানুষ।
ঈদের আগে ডেঙ্গু, গুজব এবং ঈদের পরে সড়কে মৃত্যুর মিছিলকে ছাপিয়ে এখনও সাধারণের আলোচনায় কোরবানির পশুর চামড়া। লাখ টাকার অধিক দামের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র দুই-তিনশ টাকায়। খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র পাঁচ টাকায়। স্মরণকালের মধ্যে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম এভাবে কমে যাওয়ার কোনো নজির নেই। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা গরিব-দুঃখীর মাঝে দান করে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ। ঈদ উপলক্ষে যারা আশা করেছিল বাড়তি কিছু টাকা হাতে আসার, তারা সেই প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর যারা এই দান করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের অনেকেই ক্ষোভে-দুঃখে নষ্ট করে ফেলেছে পশুর চামড়া। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি। চামড়া আমাদের দ্বিতীয় প্রধান রফতানি পণ্য। ঈদে যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়, তা আমাদের চামড়া রফতানির প্রধান উৎস। ফলে চামড়ার বাজারের ধস থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গরিব মানুষ এবং রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে লাভবান একটি শ্রেণিও রয়েছে। সেই শ্রেণিটিকে চিনিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কারণ, এই শ্রেণিটি নিজেরা লাভবান হতে গিয়ে ক্ষতি করেছে রাষ্ট্রের। ক্ষতি করেছে গরিব মানুষের। যাতে করে সম্পদের প্রবহমানতাও নষ্ট হয়েছে।
শুরুতে বলেছিলাম, দায়িত্ববোধের কথা। চামড়ার বাজারে ধসের পেছনে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের কাঁধে ফেলে দিলেও, আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। আমরাও এড়িয়ে যেতে পারি না, আমাদের কাঁধে আসা দায়িত্ব, দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গ। সরকার দায়িত্ব নিয়ে দেশের উন্নয়ন করছে। সেই উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে আমাদেরও রয়েছে দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা। আমরা সবাই নিজেদের দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ হলেও তা পালনে আগ্রহী নই। বরং অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দিতে আগ্রহী। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা। এই মশা নোংরা পানিতে ডিম পাড়ে না, বংশবিস্তার করে না। আমাদের ঘরের কোণে জমে থাকা পানিতেই এর বিস্তার। আমাদের নিত্যব্যবহার্য ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশন, ফুলদানির জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বাস। আমাদের অসচেতনতায় আশপাশে ফেলে দেওয়া কৌটা, গাড়ির টায়ার, ডাবের খোসায় জমে থাকা পানিই এডিসের আশ্রয়। এটা আমরা সবাই এতদিনে জেনে গেছি। অথচ এই মশাদের ধ্বংস করতে আমরা নিজেরা কতটা উদ্যোগী, সেই প্রশ্ন রয়ে যাবার পরও আমরা তাকিয়ে
থাকি নগর/শহর কর্তৃপক্ষের দিকে। তারা সময়মতো মশা নিধনের জন্য ওষুধ ছিটায় না, ড্রেন সংস্কার করে না, খাল-নালা পরিষ্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করে না। রাস্তাঘাট সংস্কার হয় না সময়মতো, এতে করে মশার বংশবিস্তার সহজ হয়। তাই সাধারণ মানুষের অভিযোগ এ দিকে। এটা সত্যি, নগর-শহর পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষেরও একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে, তারা তা এড়িয়েও যেতে পারে না। কিন্তু আমাদের প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের দায়ও কি আমরা এড়িয়ে যেতে পারি? এ ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ যদি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসি। তা হলে সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
মানুষের চলাচলের সুবিধার জন্য সরকার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করছে। সড়ক প্রশস্ত করছে। কিন্তু এই প্রশস্ত সড়কগুলোর কতটুকু অংশ আমরা ব্যবহার উপযোগী পাই? প্রায় প্রতিটি সড়কের এক-তৃতীয়াংশই থাকে দখলে। কোথাও হকার, কোথাও পার্কিং, কোথাও নির্মাণসামগ্রী আবার
কোথাওবা রীতিমতো হাট-বাজার। ফলে যান চলাচলে নেমে আসে স্থবিরতা। গাড়ির চাকা থমকে যায়। সড়কগুলো সচল রাখার দায়িত্ব কার? সরকার জনসাধারণের সুবিধার্থে নির্মাণ করেছে প্রশস্ত সড়ক। সেই সড়ক সচল রাখতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারকারী প্রতিটি মানুষেরও দায়িত্ব রয়েছে। আমরা যদি সড়ক আটকে গাড়ি পার্কিং করি, তাহলে সড়ক স্থবির হবে, যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে। আবার প্রশাসন যদি সড়ককে গতিশীল রাখার উদ্যোগ না নেয়, অবৈধভাবে সড়ক ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলেও বাড়তে থাকবে অবৈধ ব্যবহারের প্রবণতা। এ ক্ষেত্রেও উভয়পক্ষেরই দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট। তাই আমরা সবাই যদি দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার প্রবণতা বাদ দিয়ে, অন্যের ওপর দোষারোপ না করে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি, তাহলেই সবক্ষেত্রে গতিশীলতা আসবে, নির্বিঘ্ন হবে আমাদের এগিয়ে যাওয়া।
লেখক: সাংবাদিক, কবি
ভালো লেখা, প্রয়োজনীয় লেখা।