দিল্লির মসনদ কার?
সংবাদ বাংলা: নির্বাচনি ফলাফলের দোরগোড়ায় পৌঁছে রাজনৈতিক মহল দ্বিধাবিভক্ত৷ একদিকে এনডিএ, অন্যদিকে ইউপিএ৷ দু-পক্ষের দাবি পরবর্তী সরকার গড়তে চলেছে তারাই৷ চাপ আরো তুঙ্গে তুলে দিয়েছে বুথ-ফেরত সমীক্ষা৷ এখন কাঠগড়ায় ইলেক্টনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম৷
দু-মাস ধরে চলা সাধারণ নির্বাচন প্রক্রিয়া অবশেষে অন্তিম ক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে৷ দিল্লির মসনদ কার কপালে জুটবে, জানতে আর দেরি নেই৷ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দেশের রাজনৈতিক বিরোধী শিবিরের মাথায় বজ্রপাত ঘটিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ‘এক্জিট পোল’ বা বুথ-ফেরত সমীক্ষা৷
সবক’টি সমীক্ষক সংস্থার ইঙ্গিত, ভারতে আরো একবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ বা এনডিএ সরকার৷ প্রতিবার নির্বাচনে ভোটগ্রহণ পর্ব সমাপ্ত হলে বুথ ফেরত সমীক্ষা হয়ে থাকে৷ যতটা সম্ভব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে এই সমীক্ষা চালায় সংস্থাগুলি৷ তবে সমীক্ষা যে একশ’ শতাংশ মিলে যায়, তেমনটা নয়৷ যেমন ২০০৪ ও ২০০৯ সালে মোটেও মেলেনি৷ এখন প্রশ্ন, তবে বুথ-ফেরত সমীক্ষা নিয়ে ভয় কিসের?
বিরোধীরা পরাজয়ের ইঙ্গিত পেয়ে হতাশা থেকে ইভিএমকে দোষারোপ করছে৷ এমনটা মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুজিত রায়৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘বিরোধীদের কাণ্ডকারখানা দেখে বাংলা সাহিত্যের হযবরল-র দুটি চরিত্র হিজবিজবিজ ও কাকেশ্বর কুচকুচের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ মোদী-বিরোধীদলগুলির হাতে আর কোনো অস্ত্র নেই৷ এক্জিট পোলের ফল দেখে ইভিএমের ঘাড়ে দোষ চাপাতে উঠেপড়ে লেগেছে৷ তাতে স্পষ্ট হচ্ছে যে, এবার নির্বাচনের ফলাফল মোদীর পক্ষেই যাচ্ছে৷ শোচনীয় পরাজয় হতে চলেছে বিরোধীদের৷ ভালো করে দেখলে বোঝা যাচ্ছে, যে দলগুলি নিজেদের রাজ্যেই ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করেছে, তারাই বেশি গলা চড়াচ্ছে৷ যেমন, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল, বিহারের আরজেডি ও অন্ধ্রের টিডিপি৷ ১৯৮২ থেকে ইভিএমে ভোট হচ্ছে৷ আজকে হঠাৎ ইভিএমকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে কেন?”
২২টি বিরোধী দল জাতীয় নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের দাবিসনদ পেশ করে এসেছে৷ ইভিএমে কারচুপির সন্দেহ থেকে সরছে না বিরোধী শিবিরে থাকা দলগুলি৷ মঙ্গলবার নতুন দিল্লিতে পরপর দু-বার বৈঠকে বসেছিলেন বিজোপি-বিরোধী ২২টি দলের প্রতিনিধিরা৷ তাতে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গোহলট ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের পাশাপাশি ছিলেন কংগ্রেসের রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা গুলামনবি আজাদ, তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন, সমাজবাদী পার্টির রামগোপাল যাদব, বহুজন সমাজ পার্টির সতীশ মিশ্র, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই-এর ডি রাজা, আরজেডি-র মনোজ ঝা, ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি প্রমুখ৷
এই প্রসঙ্গে গুলামনবি আজাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘আমাদের দাবি, প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রের ৫টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্র চিহ্নিত করে আগে ভিভিপ্যাটের স্লিপ ও ইভিএম গণনা করা৷ কোনো বুথে যদি গরমিল ধরা পড়ে, তাহলে সংশ্লিষ্ট লোকসভা কেন্দ্রের সম্পূর্ণ ভোটগণনা আরো একবার করতে হবে৷” নির্বাচন কমিশন দাবিগুলি খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে৷
বুথ-ফেরত সমীক্ষাকে সামনে রেখে বিরোধীদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা চলছে, মনে করছে কংগ্রেস৷ দলের সাধারণ সম্পাদক রাহুল গান্ধীর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র দলীয় কর্মী, সমর্থকদের উদ্দেশে অডিও বার্তা দিয়েছেন৷
প্রিয়াঙ্কা বলেছেন, ‘‘প্রিয় কর্মী ভাই-বোনেরা, গুজব ও এক্জিট পোলে দয়া করে মনোবল হারাবেন না৷ মনোবল ভাঙার লক্ষ্যে এসব রটানো হচ্ছে৷ গণনা-কেন্দ্র ও স্ট্রং রুমে দৃঢ়তার সঙ্গে সজাগ থাকুন৷ আমাদের আশা, আপনাদের ও আমাদের পরিশ্রম সফল হবে৷”
ওদিকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন৷ একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে তার বিশ্বাসযোগ্যতা সুনিশ্চিত করার আবেদন জানিয়েছেন৷ টুইটে মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকা ইভিএমের সুরক্ষার দায়িত্ব কমিশনের৷ গণতন্ত্রের পক্ষে অমঙ্গল, এমন সমস্যার কোনো ঠাঁই নেই৷ জনগণের সিদ্ধান্তই সবার ওপরে৷ এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকা উচিত নয়৷”
তবে বুথ-ফেরত সমীক্ষা যা-ই বলুক কেন্দ্রে আরো একবার ইউপিএ-৩ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) সরকার গড়ার সম্ভাবনা প্রবল, এমনটাই মনে করছে বিরোধী শিবির৷ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ মানস ভুঁইয়া ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘প্রথম থেকেই ভারতীয় জনতা পার্টি নির্বাচন কমিশন ও বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমকে করায়ত্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে৷ মনে রাখতে হবে, প্রচারের শুরু থেকে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ বলে আসছেন তাঁরা ৩০০-র বেশি আসন পাবে৷ এখন এক্জিট পোল তাই বলছে৷ এই দুয়ের মধ্যে মিল স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহের জন্ম দিয়েছে৷ আমরা বহুবার কমিশনের দ্বারস্থ হয়ে অভিযোগ জানিয়েছি৷ এখন ফল প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করব৷ আমরা মনে করি, নিশ্চিত জয় হবে বিরোধীদের৷ কিন্তু, যদি সমীক্ষা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় তাহলে বিরোধীদের অভিযোগ প্রমাণিত হবে৷’’
এরইমধ্যে ইউপিএ জোটে টানার চেষ্টা চলছে তেলুগু রাজ্যের দুটি দল টিআরএস এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেসকে৷ প্রয়োজনে টিআরএস প্রধান কে চন্দ্রশেখর রাওকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ দেওয়ার কথাও ভাবছেন শিবিরের নেতারা৷ বিরোধী শিবিরের নেতারা বলছেন, ‘‘আরো একবার ইউপিএ-৩ গড়া নিয়ে ২২টি বিরোধী দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে৷ ধরে নেওয়া হচ্ছে, যে-কোনো পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি বিজেপিকে প্রথমে সরকার গড়ার ডাক দেবেন৷ কিন্তু বিরোধী শিবিরের হাতে উপযুক্ত সংখ্যা থাকবে৷ সরকার কার, ঠিক করবেন কে চন্দ্রশেখর রাও এবং জগণমোহন রেড্ডি৷ তাই শিবির আরো মজবুত করতে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে৷ কেসিআরকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়া হবে৷”
গোটা দেশের বহু স্ট্রংরুমে রাতপাহারা শুরু দিচ্ছেন বিরোধী নেতারা৷ ইভিএম বিতর্ক গগনচুম্বি হচ্ছে দেখে সরকারিভাবে বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে নির্বাচন কমিশন৷ কমিশনের দাবি, ‘‘অভিযোগ ভিত্তিহীন৷ ইভিএম সুরক্ষিত রয়েছে৷ সিসিটিভি-র নজরদারিতে রয়েছে৷ এমনকি প্রোটোকল মেনে স্ট্রংরুমে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন রাখা হয়েছে৷’’ যদিও তারপরও কোথাও ইভিএম ভর্তি গাড়ির ভিডিও, কোথাও ইট ভাটায় ইভিএম জড়ো করার ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সোশাল মিডিয়ায়৷ উত্তাল গোটা দেশ৷ সব দেখে-শুনে সাধারণের মনে প্রশ্ন, ‘‘ইভিএম তুমি কার?”
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment