নববর্ষের সাথে ইলিশের কী সম্পর্ক?
মো: মুরাদ হোসেন: ক’দিন বাদেই পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। বৈশাখী হাওয়ায় দোল লেগেছে ইলিশের গায়ে। বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে নানা আয়োজন শুরু হয়েছে। বরাবরের মত পহেলা বৈশাখের মূল অনুষঙ্গ করে তোলা হয়েছে পান্তা-ইলিশকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে পান্তা-ইলিশ ছাড়া যেন এই উৎসবই পরিপূর্ণতা পায় না। কিন্তু বাঙালির নববর্ষের সাথে কী সম্পর্ক রয়েছে ইলিশের? পহেলা বৈশাখে আমি ইলিশ খাওয়ার বিরুদ্ধে এখন জোর দাবি উঠছে। এই সময়টি ইলিশের প্রজননকাল। বৈশাখ কেন্দ্র করে ইলিশের চাহিদা বেড়ে যায়। আর ইলিশের যোগান দিতে তাই ঝাটকা ধরাও বেড়ে যায়। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, বাংলা নববর্ষের যে ঐতিহ্য তাতে ইলিশ খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এদিন কত ধরনের ভর্তা করা যায়, সবজি রান্না করা যায়— এসব হতে পারে। সেখানে কোরমা, পোলাও, ইলিশের সম্পর্ক নেই। এটা একটা বাণিজ্যিক উপকরণ। তবে কেউ যদি ইচ্ছে করে নববর্ষে কোরমা, পোলাও, ইলিশ খায়, তাহলে সে খেতে পারে।
যদিও পান্তা-ইলিশের সাথে পহেলা বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও এখনই ইলিশ মাছ কিনে রাখছেন অনেকেই। বৈশাখকে উপলক্ষ করে ইলিশের বাজারে রীতিমতো আগুন লেগেছে! এক কেজি ওজনের ইলিশ হলেই দাম তিন থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। ওজন যদি আরো বেশি হয় তাহলে তো তার কদর আকাশচুম্বী। গতকাল শুক্রবার হাতিরপুল বাজারে এক মাছ ব্যবসায়ী দুই কেজি ওজনের একটি ইলিশের দর হেঁকেছেন ১০ হাজার টাকা! রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ টাকা থেকে ২৮০০ টাকা পর্যন্ত। দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। আর হিমায়িত ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা কেজি।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য চড়া দামে ইলিশ কেনার প্রতিযোগিতায় সামিল হওয়া কতটা সমীচীন তা নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এই প্রথম এভাবে ইলিশ কেনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রচারণায় নেমেছেন বাংলাদেশের একদল সংস্কৃতি কর্মী। তারা বলছেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ঐতিহ্যের সঙ্গে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। ঢাকার কাঁচা বাজারগুলোতে এখন সবচেয়ে দুস্প্রাপ্য পণ্য হয়ে উঠেছে ইলিশ। পহেলা বৈশাখের আগে অনেকেই এক জোড়া ইলিশ মাছ কেনার জন্য মরিয়া। আর মাছ বিক্রেতারাও এর সুযোগ নিচ্ছেন পুরোদমে। দাম বেড়ে যাবে এমন আশংকায় অনেকে অবশ্য আগে-ভাগেই মাছ কিনে রাখছেন ফ্রিজে। ইলিশের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় পহেলা বৈশাখে ইলিশ বর্জন করে মাছ বাঁচানোর আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বেশ ভালোভাবেই চলছে এমন প্রচারণা।
বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, ইলিশ খাওয়ার সাথে বাংলা নববর্ষের আদৌ কোন যোগাযোগ নেই। বাঙ্গালির নববর্ষ উদযাপনের চিরায়ত সংস্কৃতির সাথে ইলিশের কোন সম্পর্ক নেই। বৈশাখে যখন খরার মাস যখন কোনো ফসল হতো না তখন কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকতো না। সুতরাং তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সুতরাং এটা মোটেও সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতো। গ্রামবাংলায় নববর্ষের উৎসবই ছিল খুব ছোট আকারে। কৃষাণী আগের রাতে একটি নতুন ঘটে কাঁচা আমের ডাল ভিজিয়ে রাখতো, চাল ভিজিয়ে রাখতো। সকালে কৃষক সেই চাল পানি খেত, এবং শরীরে কৃষাণী পানিটা ছিটিয়ে দিত। তারপর সে হালচাষ করতে যেত। দুপুরবেলায় পান্তা খেতে পারতো কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে। কখনো কখনো একটু শুটকি, একটু বেগুণ ভর্তা ও একটু আলু ভর্তা দিয়ে খেত”।
লেখক: যুগ্ম-সম্পাদক, প্লাটফর্ম-একটি সমাজসেবা সংগঠন