পদ্মায় মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর পরিব্রাজক ফোরামের নৌভ্রমণ
চাষী সিরাজুল ইসলাম: পদ্মায় মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর পরিব্রাজক ফোরামের নৌভ্রমণ নিয়ে কিছু কথা। গত ১৮ মার্চ ময়ূরপঙ্খি নাওয়ে পদ্মা ভ্রমণের সুখস্মৃতি। সকাল পৌনে সাতটায় ধানমন্ডি থেকে বাসে চেপে বসলাম। গুলিস্তানে এসে বাস পাল্টিয়ে ৭টা ২০ মিনিটে স্বাধীন পরিবহনে মাওয়া শিমুলিয়া ফেরীঘাটের উদ্দেশ্যে ফের যাত্রা শুরু হলো। সকাল ৮ টা ২০-এ পৌছে গেলাম ফেরীঘাটে। পৌঁছে দেখি আমিই প্রথম ব্যক্তি মাওয়া ঘাটে পৌঁছেছি। দেখি তখনো আমার আগে কেউ এসে পৌঁছেনি। মাওয়া ঘাটের নিরালা হোটেলে প্রাত:রাশের ব্যবস্থা ছিল ফোরাম সদস্যদের। আমি আয়োজকদের আসতে দেরী দেখে ডায়াবেটিস রুগী হওয়ার কারণে আগে ভাগেই প্রাত:রাশ সেড়ে নিলাম। এরপর দেখলাম একে একে সবাই আসতে শুরু করেছেন। ফোরামের প্রধান উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর খান ভাই এলেন পৌনে দশটায় কয়েকজনকে নিয়ে আলী আহমদ স্যারের মাইক্রোবাসে করে। আলী আহমদ স্যারের আসতে দেরী হওয়াতেই এই দেরী। যেখানে ন’টায় নাস্তা খেয়ে সাড়ে ন’টায় ময়ূরপঙ্খী নাওয়ে চড়ার কথা,সেখানে অযাচিত দেরী হয়ে গেলো আরকি!
সে যাইহোক ইতোমধ্যে ততোক্ষণে সবাই চলে এসেছেন। চলে এসেছেন আমার স্কুল জীবনের প্রিয় শিক্ষক আলী আহমদ স্যারও। তিনি আমাকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরলেন। ৪২ পর তার সাথে মোলাকাত হলো। উনি নাস্তা করলেন না। সে সময় যখন ফোরামের সবাই নাস্তায় ব্যস্ত তখন আলী আহমদ স্যার আর আমি কুশলাদি জেনে নিচ্ছিলাম। এর ফাঁকে আমি ছবি তুলছিলাম। ছবি তোলা আমার হবি। মোবাইলের ক্যামেরা সেটা সহজ করে দিয়েছে।
এক সময় নাস্তা শেষে করে সবাই নিরালা হোটেলের পাদদেশে ফটোসেশনে জড়ো হলো। ফটোসেশন শেষ করে ফেরীঘাটের পল্টুনে রাখা ময়ূরপক্ষী নাওয়ের দিকে ছুটলাম আমরা। ঘড়িতে তখন সোয়া দশটা। কথা ছিল সকাল সাড়ে ৯টায় নৌভ্রমণের শুরু হবে। কিছুটা দেরী হলো বৈকী!
আমি সদস্যদের নাওয়ে ওঠার সময়কার ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপ করলাম। তারপর জুতা খুলে নাওয়ের লাল নীল তীরপল ঢাকা ছাদের ওপর গিয়ে বসলাম। ওপরে সোফা চেয়ার টেবিল দিয়ে বসার ভালো ব্যবস্থাই করেছেন ময়ূরপঙ্খি নাওয়ের মালিক শাহে আলম ভাই। এটি তিনি বানিয়েছেন শিলাইদহের রবি ঠাকুরের বোট দেখে। বুঝা গেলো বেশ সংস্কৃতিবান মানুষ শাহে আলম ভাই। উনি আমার ফেসবুক বন্ধু ছিলেন। এই প্রথম তার বোটে মোলাকাত হলো তারই সাথে। আনন্দবোধ হলো। আমার সাথে সাক্ষাতে উনিও প্রীত হয়েছেন পরবর্তীতে বক্তৃতায় বললেন।
তার আগে নাস্তা খাওয়ার সময় খারশেদ ভাই বললেন,আপনি কী চাষী সিরাজুল ইসলাম। আমি মনে করলাম উনি আমাকে চিনেও এমনিতেই বলেছেন। তাই উত্তরে বললাম, জ্বিনা আমি চাষী নই। উনি বললেন আপনি চাষী হয়েও না বললেন এটা ঠিক হলোনা। আসলে কয়েকবার ফোনে কথা হলেও এই প্রথম আমাদের দেখা হলো। তাই কিছুটা মিস আন্ডারস্যান্ডিং! উনি দেবদাসের সময় বড় ভাই চাষী ভাইয়ের সাথে কাজ করেছেন। দেখেছেন চাষী ভাই ডান হাতে ঘড়ি পড়েন। আমার ডান হাতে ঘড়ি পড়া দেখে বললেন,চাষী ভাইর মতো আপনিও ডান হাতে ঘড়ি পড়েন। বললাম তাকে আমি ফলো করি।
আসন গ্রহণ করেই অনেকে ছবি তোলাতুলি শুরু করলেন। গবেষক লেখক আবদুর রশিদ খান ভাই আমাকে পেয়ে কিছুটা উচ্ছ্বসিত হলেন। আমাকে নিয়ে ছবি তুলে নিলেন। এর পরপরই সভাপতির আসনে আসিন হলেন ফোরামের সভাপতি এসএমএ খালেক ভাই। প্রধান অতিথির আসনে বসলেন আমার স্কুল জীবনের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় আলী আহমদ স্যার। তখন ময়ূরপঙ্খী নাও ছুটে চলেছে প্রমত্ত পদ্মার ওপর দিয়ে। যদিও পদ্মার তেমন তেজ নেই। নেই ঢেউয়ের অবিরাম বাড়াবাড়ি আর দুলুনি! ফাগুন প্রায় শেষ। চৈত্রের আগমনী শুরুর আর দেরী নেই। তাই বুঝি বর্ষার অমিত তেজী পদ্মার তেজী রুপের বালাই নেই। যেনো মরা ন্মৃয়মান এক পদ্মা ! এ পদ্মা এখন শুকিয়ে গেছে। বর্ষাকাল নয় বলে এর তেজও কম। শান্ত নিরিবিলি নিস্তেজ রুপ নিয়ে বহমান এক সময়ের প্রমত্তপদ্মা! মাঝে চর পরে গেছে। সরু হয়ে গেছে পদ্মা। যেনো শীর্ণকায় এক নদী! এর ওপর দিয়েই পদ্মাসেতু দৃশ্যমান। হয়তো মাস (জুন) তিনেক পড়েই আমরা যানবাহনে করে স্বপ্নের সেতু দিয়ে পদ্মা পাড়ি দিব। সে এক এক্সসাইটিং ব্যাপার অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!
ময়ূরপক্ষী চলন্ত পথে সাড়ে এগারোটার দিকে একটা ঘাট দিল। তার আগে চা চক্রের পর্ব শেষ গয়ে গেছে। চরের মধ্যে থামলো আমাদের ময়ূরপক্ষী নাও। জয়গাটার নাম বেজগাঁও। লৌহজংয়ের বেজগাঁও গ্রাম। তার আগে পদ্মা রিসোর্ট, সম্ভবত কনকসার, দীঘলী বাজার দেখা গেলো। আরেকটা বেজগাঁও আছে তার নাম শ্রীনগর বেজগাঁ। কৃষিব্যাঙ্কের সাবেক ডিমডি জয়নাল আবেদীন ভাইদের গ্রাম সেটা।
এই প্রথম লৌহজংয়ের বেজগাঁও গ্রামে এলাম। পদ্মার তীর সংলগ্ন ঘেষেই গড়ে উঠেছে বেজগাঁও মৃধা বাড়ি। অনিন্দ সুন্দর একটি বাড়ি! এর ভেতর বাহির নান্দনীকতায় ভরপুর। গাছগাছালি আর ফুলের বাগানে সজ্জিত-সমৃদ্ধ এক নৈসর্গিক বাড়ি। এ যেনো চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট! বাড়িটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নান্দনিক টিনের তিন তলা বাড়ি! লাল রংয়ের টিনে আচ্ছাদিত বাড়িটি।বিক্রমপুরে নাকি এটিই একমাত্র তিনতলা টিনের বাড়ি। আমার জানা নেই, হতেও পারে। দর্শনার্থীদের জন্য এ মৃধাবাড়ি সব সময় উন্মুক্ত। এ সুন্দর বাড়িটিতে আমরা ফটোসেশন করলাম। তারপর ধাবমান হলাম ময়ূরপঙ্খী নাওয়ের দিকে। তখন বেলা বারোটার মতো।
ময়ূরপঙ্খী এবার ছুটে চলেছে পদ্মার ওপর একদম পদ্মাসেতুর কাছ দিয়ে শরীয়তপুরে মাঝির বাড়ি ঘাটের দিকে। পদ্মায় বাতাস নেই। কিছুটা ভ্যাপসা গরম! তীরপালের ছাদে ঝুলানো বাঁধা কলার গাদি থেকে কলা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া শুরু হলো। নাওয়ে উঠে মৃধা বাড়ি যাওয়ার পথেই লাল চা-দুধ চা একপ্রস্থ হয়ে গিয়েছিল। কলা খাওয়ার পর আমি সহ আরো দু’একজন দ্বিতীয় প্রস্থ চা পানে মগ্ন হলাম। অন্যরা পদ্মাসেতু ও আড্ডায় নিমগ্ন ছিল। আর জাহাঙ্গীর ভাই হিসাব নিকাশ- উপস্থিতি নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি রীতিমত ঘামছিলেন। অত্যন্ত করিতকর্মা লোক তিনি। আমি ছবি ও ভিডিও করে যাচ্ছিলাম,যা স্মৃতি হয়ে থাকবে। সোয়া এক ঘন্টা জার্নি করে আমরা মৃধা বাড়ি থেকে মাঝির বাড়ি ঘাটে এসে পৌঁছলাম। সেখানে নোঙর গাড়া হলো। জুম্মার নামাজের সময় হয়ে এসেছে। ঘাটের কাছেই আমরা পবিত্র জুম্মার নামাজ আদায় করে ঘাটে রাখা ময়ূরপঙ্খীকে পশ্চাতে রেখে ফটোসেশান করলাম। কিছু ভিডিও ও করলাম।
দুপুর প্রায় দুটা। জাহাঙ্গীর ভাই ফোরামের সভাপতি এসএমএ খালেক ভাইর অনুমতি নিয়ে শুরু করলেন নৌভ্রণে অংশ গ্রহনের অনুভূতি ব্যক্ত করার। একে একে সবাই মুগ্ধতার সহিত তারা তাদের অনুভূতি আনন্দ-উচ্ছ্বাস বর্ণনা করতে লাগলেন। অন্য দিকে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন চলতে লাগলো। এক পর্যায়ে লাঞ্চের সময় হয়ে যাওয়ায় চার পাঁচ জনের বক্তৃতা খাওয়ার পরে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার খাওয়া দাওয়া শুরু হলো। ভোজের আয়োজনে সাদা ভাতের সংগে উচ্ছ্বেভাজি, ইলিশের ডিম ভাজা,বেগুন ভাজা,ভাজা ইলিশ,ঝোলদিয়ে ষোলমাছ ও দেশী মুরগীর পথ্য। সংগে ডালফ্রাই। সব মিলিয়ে চমৎকার মধ্যাহ্ন ভূরিভোজ! খাওয়ার সময় পদ্মাসেতুর একদম নিচ দিয়ে যাচ্ছিলো আমাদের ময়ূরপঙ্খী নাও। তাই সে দৃশ্যও ক্যামেরায় ধরে রাখলাম। ভিডিও করলাম। অন্যরাও তা ধরে রাখলো। এসব অনুভূতি বর্ণনা করার মতো নয়! সে এক দারুন অনুভূতি! খাওয়ার পর আবার শুরু হলো অনুভূতি ব্যক্তের সমাপনী পর্ব। শেষ পর্বে আমিও পরিচিত হলাম এবং অনুভূতি ব্যক্ত করলাম। সবশেষে প্রধান অতিথি শ্রদ্বেয় আলী আহমদ স্যার তার মনোযোগ আকর্ষণীয় বক্তব্য রাখলেন। ৪২ বছর পর আবার তার কন্ঠস্বর শুনলাম। হাস্যরস অথচ তীক্ষ্ণ মিষ্ট সুচারু বক্তব্য আশা করি সবাইকে স্পর্শ করে গেলো। শেষে সভাপতি খালেক ভাই তার মূল্যবান বক্তব্য রাখলেন। বক্তৃতায় আমার কথাও বললেন। মনে হলো এই সমিতি আরো বড় হবে আরো সমৃদ্ধ হবে। অনেক ট্যুর হবে। আগামীতে ভারত-ভুটান-নেপাল ত্রিদেশীয় ট্যুর হবে। পদ্মাসেতু চালু হলে কুয়াকাটা ট্যুর সহ আরো অনেক ভ্রমণ, ট্যুর হবে। শুধু ঘুরলেই হবেনা, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যেনো আমাদের প্রজম্মদের অভিসিঞ্চন করে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আমি বুঝেছি জাহাঙ্গীর ভাই খুব করিতকর্মা লোক। তাইতো কয়েকদিনের মাথায়ই তিনি এমন একটা নৌভ্রমণের ব্যবস্থা করতে পারলেন। সফলও হয়েছেন। তিনি পারবেন। তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তার সঞ্জীবনী শক্তি অনেক বেশী। আমরা তার সাথে আছি। থাকব। একটা কথা তিনি যেভাবে সকল ভ্রমনার্থীদের পরিচয় দিচ্ছিলেন,তাতে তাকে গুগোল বিশারদই মনে হচ্ছিল! সব শেষে ফেরার পথে ছিল দই ও রসগোল্লার মধুরেত সমাপন! অনেক দিন এ ভ্রমণের কথা মনে থাকবে।
ভ্রমণে যে অভিজ্ঞতা হবে,পৃথিবীর আর অন্য কোন কিছুতেই তা পাওয়া যাবে না ।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment