পদ্মা সেতু: স্বপ্ন হলো সত্যি
ডিসেম্বর ১১
১১:৩০
২০২০
সংবাদ বাংলা: বিজয়ের মাসে পদ্মা জয়ের আনন্দ। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান। স্বপ্ন হলো সত্যি। বৃহস্পতিবার ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে একবিন্দুতে মিলে গেছে পদ্মার দুই ক‚ল। একই সঙ্গে দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতুর পুরো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এই সেতুর ঐতিহাসিক মুহূর্তটির সাক্ষী হলো বাংলাদেশ ও পুরো বিশ্ব। বাকি কাজ শেষ করে আর মাত্র এক বছর পরই আগামী ডিসেম্বর নাগাদ পদ্মা সেতু গাড়ি চলাচলের জন্য খুলতে চায় সরকার। তবে সেতুতে রেল চলাচল করবে ২০২২ সালের জুন নাগাদ। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর কাজ শেষ হয়। ৪১তম এই স্প্যান সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির (পিলার) ওপর বসানো হয়। মূল সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের জানান, দুপুর ১২টা ২ মিনিটে ৪১তম স্প্যানের জোড়া লাগানোর মাধ্যমে পদ্মার দুই পাড় যুক্ত হলো। আমাদের স্বপ্ন সত্যি হলো।
এদিকে পদ্মা জয়ের এই মাহেন্দ্রক্ষণ ঘিরে বৃহস্পতিবার পদ্মা পারে ছিল উৎসবের আমেজ। কেবল পদ্মার দুই তীরের বাসিন্দারা নয়, ঢাকা থেকেও অনেকে যান সেতুর শেষ স্প্যানটি বসানোর কাজ নিজে চোখে দেখতে। নৌকা, ট্রলার ও স্পিডবোট ভাড়া করে তারা নদীতে ওই স্প্যানের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান নেন। শেষ স্প্যানটি বসানো হয়ে গেলে উল্লাস প্রকাশ করেন তারা। কেউ আবার জাতীয় পশু রয়েল মতো সেজে, বুকে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হতে এসেছিলেন পদ্মার বুকে।
শত প্রতিকূলতা, নানা বিতর্ক মোকাবিলা করে এবং বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্য ফেরানোর পাশাপাশি উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বপ্নপূরণে সর্বশেষ ‘স্প্যান টু-এফ’ বসানোর মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে পদ্মা সেতু। ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হয়েছে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮১ শতাংশ, মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯১ শতাংশ। পদ্মা রেল সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। রেল সেতুর পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আরও ১০ থেকে ১২ মাসের মধ্যে। পদ্মা সেতুর কাজ সম্পূর্ণ শেষ হলে ২১ জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষের যাতায়াতে সুবিধা এবং তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে। দেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চলের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। কর্মসংস্থান হবে কোটি বেকারের। একই সঙ্গে উন্নয়ন হবে আঞ্চলিক অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার।
আগের দিন বুধবার বিকালেই স্প্যানটি পিলার থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে ভাসমান ক্রেনে এনে রাখা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে স্প্যানটি নিয়ে খুঁটির দিকে রওনা দেয় ভাসমান ক্রেন। এ সময় ঘটনাস্থলে এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ স্প্যানটির একপাশে টাঙানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। অন্যপাশে চীনের পতাকা। স্প্যানটি নিয়ে ভাসমান ক্রেন যখন খুঁটির দিকে রওনা দেয়, তখন উপস্থিত কর্মকর্তাসহ সবাই উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সঙ্গে নিয়ে কর্মকর্তারা ছবি তোলেন।
সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে আলোচিত পদ্মা সেতুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বড় কাজের সমাপ্তি হলো। এরপর সড়ক ও রেলের স্ল্যাব বসানো সম্পন্ন হলে সেতু দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলার সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি খুঁটির ওপর বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাকি ৪০টি স্প্যান বসাতে ৩ বছর ২ মাস সময় লাগল।
এদিকে পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর কাজ সম্পন্ন হওয়ায় মাওয়া প্রান্তের সাধারণ মানুষ দারুণ খুশি। এখানকার স্থানীয় এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রুহুল আমিন। পদ্মা সেতুর প্রকল্পের জন্য তাদের বাপ-দাদার জমিজমা স্বল্পমূল্যে হস্তান্তর করেছেন। রুহুল আমিন বলেন, দেশের উন্নয়নে বৃহত্তর স্বার্থে বাপ-দাদার জমিজমা স্বল্পমূল্যে দিয়ে দিয়েছি। আমরা এ ভেবে খুশি যে, আমাদের বুকের ওপর দিয়ে অন্য জেলার যাত্রীরা ঢাকাসহ নিজেদের গন্তব্যে যাবে। এজন্য আমাদের এখন দুঃখ নেই।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি। মোট স্প্যানের সংখ্যা ৪১টি। সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটর। ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি। পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার। সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার। সেতু প্রকল্পে নদীশাসন হয়েছে দুই পারে ১২ কিলোমিটার। প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় চার হাজার মানুষ।
এ ছাড়া ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। নদীশাসনের কাজও শুরু হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও নদীশাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। আর ১০ ডিসেম্বর, গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২ মিনিটে ৪১তম স্প্যানটি সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় (মূল সেতুতে) ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। গত ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫ দশমিক ২ কোটি টাকা; অর্থাৎ মোট ব্যয়ের ৭৯ দশমিক ৮৯ ভাগ।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment