পরিবর্তন তো আগামীর জন্যই
মামুন রশীদ: খোলামেলা পরিবেশ আর নির্মল বাতাসের আকুতি আমাদের সবার। কিন্তু এই দুইয়ের অভাব রাজধানীতে। শ্বাস ফেলার সুযোগ নেই। বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ নেই। বুকের ভেতরে বাতাসকে কিছু সময় ধরে রাখার তৃপ্তি নেই। এই যে এতগুলো নেই, তার পেছনে দূষিত বাতাস। এর দায় আমাদের। আমরাই জেনে-বুঝে দূষিত করছি বাতাস। আবার আমরাই হা-হুতাশ করছি নির্মল বাতাসের জন্য। আমরাই বদ্ধ করে ফেলছি চারপাশ, খোলা জায়গা রাখছি না, আবার আমরাই খোলামেলা পরিবেশের জন্য অস্থির হয়ে উঠছি। এই দ্বৈতসত্তা নিয়েই আমাদের প্রতিদিনের জীবন। ঢাকায় মুক্ত বাতাসের জন্য, খোলা পরিবেশের জন্য যে কয়টি স্থান তাও রুদ্ধ হয়ে আসছে। সঙ্গে যানজট ঘরকুনো করে তুলছে। এত সময়ের অপচয়, এত প্রাণশক্তির অপচয় যান্ত্রিক করে তুলছে, অসুস্থ করে তুলছে।
ঢাকায় রয়েছি অনেক বছর। কিন্তু বলধা গার্ডেন দেখা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত বছর আগে শুনিয়েছিলেন দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু। সেই শিশির বিন্দু দেখিনি জেনে সহকর্মী এম মামুন হোসেন আমন্ত্রণ জানালেন। পুরান ঢাকার বাসিন্দা, পথঘাট চেনা। ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী বলে তার বর্ণনাও প্রাণখোলা। ঘরকুনো আমিও উপেক্ষা করতে পারি না, সেই ডাক। এক দুপুরে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে দেখা হলো, গাজীপুর জেলার বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীর স্থাপিত বলধা গার্ডেন। উদ্যান নিয়ে শুনেছি যতটা পড়েছি আরও বেশি। ফলে আগ্রহ এবং কৌত‚হল ছিল। উদ্যানে প্রবেশের আগেই সহকর্মী জানালেন, আগের পরিবেশ নেই। সাধারণ মানুষ আসে না। গবেষক, প্রকৃতিপ্রেমী ছাড়া নেহাত ঠেকায় না পড়লে কেউ ভেতরে ঢোকে না। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বললেন, ভেতরে গেলে বুঝবেন। উদ্যানে প্রবেশের জন্য ফি দিতে হলো জনপ্রতি ৩০ টাকা। ৩.৩৮ একর জায়গার ওপর তৈরি বাগানের গাছপালা দেখার জন্য বেশিই মনে হলো। শুরুতে প্রবেশমূল্য না থাকলেও, পরে ২ টাকা করা হয়েছিল। তাই বাড়তে বাড়তে আজ ৩০ টাকায় এসে ঠেকেছে। পুরো বাগান ঘুরতে সময় লাগে বড়জোর আট-দশ মিনিট। নানারকম বৃক্ষশোভিত উদ্যানে তরুণ-তরুণীরা বসে রয়েছে। তাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার জায়গাও অনেক কম। কিছু মানুষ কৌত‚হলী চোখে তাদের দেখছে। মিনিট দশকের মধ্যে গাছ দেখে বেরিয়ে এলাম।
দুই.
কয়েক দিন আগে একটি খবরে চোখ আটকে গিয়েছিল। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের শিরোনাম ছিল, ‘পার্কে বসে অসামাজিক কাজ, শতাধিক তরুণ-তরুণী ধরা’। খবরের বিস্তারিত অংশ পাঠ শেষে জানা গেল, ফরিদপুরে পৌর শেখ রাসেল শিশু পার্কে স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে তরুণ-তরুণীরা আসে। তারা পার্কের ভেতরে অসামাজিক(!) কার্যকলাপ করে। আর এই অভিযোগেই ঘটনার দিনে পার্কে থাকা শতাধিক তরুণ-তরুণী ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীকে আটক করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আটকদের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে তাদের অভিভাবকদের জিম্মায় পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের পরের অংশটি হুবহু তুলে দেই পাঠকের জন্য। ‘ফরিদপুর শেখ রাসেল শিশু পার্কে দীর্ঘদিন ধরে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে আসছিল। শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নির্মিত শেখ রাসেল শিশু পার্কে বিনোদনকে পুঁজি করে একদিকে যেমন দর্শনার্থীদের পকেট ফাঁকা হচ্ছে, অন্যদিকে বিনোদনের নামে পার্কের ভেতরে অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে। পার্কের ভেতরে যুগলদের অসামাজিক কার্যকলাপে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় দর্শনার্থীদের। অভিযোগ রয়েছে অর্থের বিনিময়ে তরুণ-তরুণীদের বিশেষ সুযোগ করে দেয় পার্ক কর্তৃপক্ষ।’
তিন.
শুরুতেই বলেছিলাম আমাদের মুুক্ত হাওয়ার আকুতির কথা বলেছিলাম। সেই আকুতি হয়তো কখনই শেষ হবে না। দিন দিন আকুতি বাড়বে, সঙ্গে সংকুচিত হতে থাকবে মুক্ত হাওয়ার পরিবেশ। ওয়ারীর বলধা গার্ডেনে যাওয়া সাধারণ মানুষের সংখ্যা কম। যখন মুক্ত হাওয়া, বিশুদ্ধ বাতাসের এত অভাব আমাদের, সেখানে ওয়ারীর বাসিন্দাদের সকাল-সন্ধ্যার একটি সময় অনায়াসেই কাটতে পারত গার্ডেনে। অসহায় মানুষ তার সন্তানকে বুকভরে বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য বলধায় নিতেই পারতেন; কিন্তু তারা নিচ্ছেন না। কারণ অতিরিক্ত প্রবেশমূল্য এবং শিশু-কিশোরদের উপযোগী পরিবেশ নেই। প্রবেশমূল্য যদি কম থাকত, তাহলে অভিভাবকরা শিশু-কিশোরদের নিয়ে নিয়মিত যেতে পারতেন আর স্বাভাবিক জনসমাগম হলে সেখানে দৃষ্টিকটু ঘটনা ঘটানোর সুযোগ কম হতো। তাতে করে স্কুল-কলেজের কিশোর-তরুণরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটানোর সময়টুকু পার্কে বসে ব্যয়ের সুযোগ পেত না, কিন্তু তা করা হয়নি; বরং উচ্চ প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করে সাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছে। আর এই সুযোগটিই নিচ্ছে কিশোর-তরুণরা। একই অবস্থা দেখেছি বগুড়ায়। সেখানের ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিনোদন কেন্দ্রগুলোর প্রবেশমূল্যই মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের বঞ্চিত করছে। ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের কর্তার পক্ষে শিশুদের নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ এতে মূল বাজেটে টান পড়বে। শিশুর জন্য তৈরি বিনোদনকেন্দ্র তাই হয়ে ওঠে কিশোর-তরুণীদের বিনোদনকেন্দ্র, যা তাদেরও সুস্থ বিনোদের পথ দেখায় না।
ঢাকায় মিরপুরের বাসিন্দা হিসেবে আমরা খোলা পরিবেশ পাই চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ওয়ারীর বলধা গার্ডেনের তুলনায় অনেক বড় জায়গা। খোলামেলা। বলধায় ছোট ছেলেমেয়েদের দৌড়ে বেড়ানোর সুযোগ না থাকলেও চিড়িয়াখানা বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে আছে। প্রায়ই ছুটির দিনে ছেলেকে নিয়ে যাই চিড়িয়াখানায়। প্রাণী দেখার চেয়ে একটু খোলা জায়গা-মুক্ত বাতাসে দৌড়ানোর সুযোগ দিতে। চলতি সপ্তাহে প্রবেশ পথের ফি দিতে হোঁচট খেলাম। চলতি মাসেই আগের ফি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ টাকা। ব্যক্তিগত বিনোদনকেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে উচ্চ প্রবেশ হার মেনে নেওয়া সহজ হলেও, সরকার বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে অস্বাভাবিক প্রবেশমূল্য কিঞ্চিৎ ভাবায়। যেখানে আমাদের শিশুদের জন্য বিনোদনকেন্দ্রের অপ্রতুলতা, সেখানে ঢাকার এক অংশের সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন শ্যামলী শিশু মেলায় কি কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মাসে একদিনও যাওয়া সম্ভব? আর সম্ভব নয় বলেই এসব স্থানে শিশুদের নিয়মিত প্রবেশ নেই।
চার.
এক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকত খেলার মাঠ। শিশুরা খেলত। এখন মাঠ-খোলা পরিবেশ ছাড়াই গড়ে উঠছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি ভবনেই অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোলা মাঠ থাকলেও, স্কুল ছুটির পর শিশুদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। নিরাপত্তাজনিত কারণেই শিশুরা সেখানে প্রবেশাধিকার পায় না। তাহলে শিশুরা খেলবে কোথায়? ঘর আর শ্রেণিকক্ষের বাইরে তাদের জন্য কোনো জগৎ আমরা খোলা রেখেছি? খেলার মাঠের পরিবর্তে তাদের হাতে এখন শোভা পায় স্মার্টফোন। নানা ধরনের গেমস তাদের বিনোদনের মাধ্যম। একই অবস্থা আমাদের কিশোর-তরুণদেরও। তাদেরও ঘর-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদ্ধ পরিবেশের বাইরে সুস্থ বিনোদনকেন্দ্র নেই। এই না থাকার মাঝে তাদের অবসর কাটবে কী করে? তাদের মানসিক বিকাশ হবে কী করে? আমরা কি সেদিকটি নিয়ে ভাবছি? উন্নয়নের ফলে অবকাঠামোগত যে পরিবর্তনের ঢেউ, তা ইতোমধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছি। কিন্তু এখন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, তথা ব্যক্তির উন্নয়নের দিকেও নজর দেওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করি। মানুষের প্রথম চাহিদা খাদ্য। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের মানুষ তার অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে নজর দেয়। সেগুলো পূরণের পরই আসে ব্যক্তির মানসিক উন্নয়নের দিক। আমরা আধুনিক পৃথিবীর দিকে এগিয়ে চলেছি, সেই পথে আমাদের সন্তানদেরও এগিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের মানসিক বিকাশ জরুরি। আমরা যদি তাদের আগামী পৃথিবীর জন্য মানসিকভাবেও প্রস্তুত না করি, তাহলে তারা আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে কীভাবে? বেশ আগে একটি গল্পের ভেতরে বর্ণনায় পড়েছিলাম, যা অনেকটা এ রকম গণচীনের মহান নেতা মাও সে তুং রয়েছেন লংমার্চে। অসংখ্য মানুষ তার সঙ্গে। লংমার্চের পথেই পড়েছে একটি পার্ক। সেখানে বসে রয়েছে একজোড়া তরুণ-তরুণী। লংমার্চে অংশ নেওয়া অতিউৎসাহী কেউ কেউ তাদের নিয়ে আসেন মাও সে তুংয়ের সামনে। সবাই যখন বিপ্লবের জন্য, পরিবর্তনের জন্য লংমার্চে তখন ওই তরুণ-তরুণী কেন পার্কে, এজন্য ক্ষোভ। তখন অতিউৎসাহীদের উদ্দেশে মাও সে তুং বলেন, আমাদের এই বিপ্লব, লংমার্চ তো এদের জন্যই। বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাইয়ে যাইনি। তবে এটুকু বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের সব অর্জন, সব বিপ্লব, পরিবর্তন তো আগামীর জন্যই। আজকের শিশু-কিশোর-তরুণদের জন্যই। তাদের যদি আমরা সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ না দেই, তো উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে কারা?
লেখক: সাংবাদিক, কবি
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment