ফিরছেন মাহাথির; নির্বাচনে লড়বেন লাংগকাই থেকে
সংবাদ বাংলা: মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ আগামী ৯ মে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে রির্সোট দ্বীপ লাংগকাই এলাকা থেকে নির্বাচন করবেন। দেশটির প্রধান বিরোধী জোট রোববার এই ঘোষনা দেয়। সিনহুয়া বলছে, দেশটির ২১ বছরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির (৯২) বিরোধী জোট পাকাতান হারাপানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জোটটি বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের জোট বারিসন ন্যাশনাল কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের পর মাহাথির বিরোধী জোটের সাথে জড়িত হন। রাজনীতিতে যোগদানের আগে মাহাথির প্রথম জীবনে লাংগকাই দ্বীপে একজন মেডিকেল কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে দ্বীপটিকে তিনি দেশের প্রধান পর্যটন দ্বীপ হিসাবে গড়ে তোলেন।
মাহাথিরের জাদুর ছোয়ায় পাল্টে যায় মালয়েশিয়া: একসময়ের মালয়েশিয়া ছিল দারিদ্র্যপীড়িত একটি অগোছালো রাষ্ট্র। শুধু কি দরিদ্রতা? দরিদ্রতার পাশাপাশি নিরক্ষরতা আর পশ্চাদমুখিতার কারণে অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা কাটানোর কোনো উপায়ই বলতে গেলে ছিল না। এরপর পাল্টানোর গল্পটাও কিন্তু একদিনের নয়। মাহাথির মোহাম্মদের হাত ধরেই দারিদ্র্যপীড়িত মালয়েশিয়া পৌঁছে যায় স্বপি্নল সাফল্যের বিশ্বে। স্বাধীনতার সময় যে মালয়েশিয়ার অধিকাংশ জনসমষ্টি ছিল বেকার অথবা অর্ধবেকার, মাত্র দুই দশকে নিজের দেশের বেকারত্ব ঘুচিয়ে সেই মালয়েশিয়ায় কর্মরত রয়েছেন বিদেশের লাখ লাখ কর্মী। স্বাধীনতার সময় এমনকি পরবর্তী সময়েও যে মালয়েশিয়া প্রায় প্রকম্পিত হয়েছে নিম্নস্তরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, সেই মালয়েশিয়া আজ রূপান্তরিত হয়েছে একটি সুস্থ, নিরাপদ, উদার, কল্যাণমুখী জনপদে।
ডা. মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল পর পর পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৩ সালের ৩০শে অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। টেংকু আবদুর রহমান প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহুধাবিভক্ত দেশটিতে রোপণ করেন ঐক্যের বীজ। ঐক্যের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে দেশ পরিবর্তনের যে ধারার সূচনা তিনি করেছিলেন তা তার উত্তরসূরি আবদুল রাজ্জাক, টোয়াংকু ইসমাঈল এবং ডা. মাহাথির বিন মোহাম্মদ ধরে রেখেছিলেন। এর মধ্যে শেষোক্তজন কেবল ধারা বজায় রেখেই ক্ষান্ত হননি। তার নীতি আদর্শ আর দেশ পরিচালনার জাদুস্পর্শে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন অন্য সবাইকে। তিনি আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ও রূপকার হিসেবে পৃথিবীতে নন্দিত হয়েছেন।
জরিপ বলছে, মাহাথিরের জন্য সহজ হবে না: অন্যদিকে দুর্নীতির কেলেঙ্কারি আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে। তবে আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আগস্টের মধ্যে তাকে জাতীয় নির্বাচন দিতেই হবে, যদি কোনো অঘটন না ঘটে। সেই নির্বাচনে তার সামনে এখন সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তবে নিরপেক্ষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিজয় অর্জন করা বিরোধীদের জন্য খুবই কঠিন হবে। কারণ, নিজেদের শিবিরের মধ্যে রয়েছে বিভক্তি। তাছাড়া তাদের পক্ষে যাবে না, এমনভাবে নির্বাচনী আসনের সীমানা পরিবর্তন করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিম এক সময় পরস্পরে ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দুর্নীতি ও দেশ পরিচালনা দেখে মাহাথির সেই শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের জোট চায় নির্বাচনে বিজয় অর্জন করতে। যদি সেটা করা যায় তাহলে আনোয়ার ইব্রাহিমের ক্ষমতায় ফেরা এবং পরে কোনো এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ তৈরি হবে। যদি নির্বাচনে বিরোধীরা বিজয়ী হয় তাহলে তারা সময়ক্ষেপণ না করে আনোয়ার ইব্রাহিমকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় রাজকীয় ডিক্রি আদায়ের চেষ্টা করবে। এমন ডিক্রি জারি হলে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে কোনো বাধা থাকবে না। বিরোধী দলীয় জোটের এক সম্মেলনে এ ঘোষণা দিয়েছেন সেক্রেটারি জেনারেল সাইফুদ্দিন আবদুল্লাহ। এছাড়া নির্বাচনে বিরোধী দলীয় জোট থেকে উপপ্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হবেন আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজা ওয়ান ইসমাইল। তাকে বলা হয় মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে জীবন্ত কিংবদন্তী। তিনি যদি এবার জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হন তাহলে তিনিই হবেন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সী একজন রাষ্ট্রপ্রধান, একজন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি কি এই ইতিহাস গড়তে পারবেন! নিরপেক্ষ জরিপ কিন্তু তা বলে না। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ক্ষমতায় বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) জোট।
ডিসেম্বরে নিরপেক্ষ জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মারদেকা সেন্টার একটি জরিপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায়, বর্তমান ক্ষমতাসীন বিএন জোটকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নাও হতে পারে। রোববার দ্য মালয়েশিয়ান ইনসাইট রিপোর্ট করেছে, নির্বাচনে বিএন জোট তাদের পপুলার ভোট হয়তো কম পেতে পারে। কিন্তু তারা পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। মারদেকা সেন্টারের পরিচালক ইব্রাহিম সুফিয়ান বলেছেন, বিরোধী দলের ভিতরে রয়েছে বিভক্তি। এ জন্য মাহাথির নেতৃত্বাধীন জোটটি সুবিধা নাও পেতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ। এর সুফল পাবে সরকার। এর আগে বিরোধী জোটে ২০১৩ সালের নির্বাচনে ছিল দ্য প্যান-মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টি (পিএএস)। তারা এখন মাহাথির নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে নেই। তাই ইব্রাহিম সুফিয়ান বলেন, এখন যেভাবে বিরোধী জোটে ভাঙন দেখা যাচ্ছে, বিভক্তি দেখা যাচ্ছে তাতে বিরোধী দলের নির্বাচনে বিজয় অর্জন নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে প্রায় ২০ বছর ধরে প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন আনোয়ার ইব্রাহিম ও মাহাথির মোহাম্মদ। তাদের মধ্যে রয়েছে তিক্ত বিরোধিতা। একজন আরেকজনের নাম শুনতে পারেন না। এর ওপর ভিত্তি করেই পাল্টে গেছে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। একজন মাহাথিরে ঘোর বিরোধী ছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তাকে দেখা হতো মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এক উদীয়মান তারকা হিসেবে। কিন্তু তাদের মধ্যকার এই বিরোধে ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে আনোয়ার ইব্রাহিমকে উপপ্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর বলাৎকার ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয় আনোয়ারের বিরুদ্ধে। তাকে জেলে পাঠানো হয়। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। এরপর বিরোধী রাজনৈতিক একটি জোটের নেতৃত্ব দেন তিনি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিস্ময়কর বিজয় পান। ওই নির্বাচনে পপুলার ভোট কম পান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। তবে তার দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আবারো ২০১৪ সালে বলাৎকারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে জেলে পাঠানো হয় আনোয়ার ইব্রাহিমকে। তার বিরুদ্ধে বলাৎকারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় রাজনৈতিক পদ ব্যবহারে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় তাকে। অযোগ্য ঘোষণা করা হয় পরবর্তী নির্বাচনে, এই নির্বাচন এ বছরেই হওয়ার কথা রয়েছে। তবে তাকে ক্ষমা করে দেয়ার যদি রাজকীয় ঘোষণা আসে তাহলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। এমনই এক প্রেক্ষাপটে নাজিব রাজাকের বিরোধীরা একত্রিত করেছেন আনোয়ার ইব্রাহিম ও মাহাথির মোহাম্মদকে। তারা এখন এক হয়ে জোট করেছেন। নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছেন।
ওদিকে ‘ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ’ (১এমডিবি) তহবিলের রাষ্ট্রীয় অর্থ নিজের ব্যাংক একাউন্টে স্থানান্তর সহ নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ গ্রাস করেছে প্রধানমন্ত্রী নাজিব মোহাম্মদকে। এ নিয়ে মামলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে ১এমডিবি তহবিল থেকে ৪৫০ কোটি ডলার অপব্যবহার করা হয়েছে। এ তহবিল সৃষ্টি করেছিলেন নাজিব রাজাক। তিনি এর অপব্যবহার বা এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তদন্ত শেষে তাকে দুর্নীতি থেকে রেহাই দিয়েছে মালয়েশিয়ার এটর্নি জেনারেল।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment