বিএনপির ইশতেহারে ’রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ়’ করার প্রতিশ্রুতি
সংবাদ বাংলা: বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে ‘রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ়’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভোটের সময় যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, ক্ষমতায় গেলে তা ‘নিত্যদিনের অনুশীলনে পরিণত’ করবে দলটি। ইশেতেহারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার বিধান, গণভোট পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন, উচ্চকক্ষ সংসদ প্রতিষ্ঠা, বিরোধীদল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, ন্যায়পাল নিয়োগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট বাতিল বিশেষ ক্ষমতা আইন’৭৪ বাতিল, বেকার ভাতা প্রদানসহ ১৯ দফা প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “নির্বাচনের জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে ঐক্যমত, সকলের অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিহিংসাহীনতা- এই মূলনীতির ভিত্তিতে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ সংবিধানের এই নীতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনায় যাবতীয় পদক্ষেপের ভিত্তি হবে রাষ্ট্রের মালিকদের মালিকানা সুদৃঢ় করা। শুধুমাত্র নির্বাচনে জেতা দলের মানুষের নয়, এই মালিকানায় সকল দল, ব্যক্তি ও মতাদর্শে অন্তর্ভুক্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর প্রকাশ এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলে যেন সাধারণ মানুষের কোনো ভোগান্তি না হয় সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে দলটি। বর্তমানে চলমান কোনো প্রকল্প বন্ধ না করারও কথা বলা হয়েছে বিএনপির ইশতেহারে।
মির্জা ফখরুল বলেন, “বর্তমানে চলমান কোনো প্রকল্প বন্ধ করা হবে না। তবে মেগা প্রকল্পের ব্যয়ের আড়ালে সংঘটিত দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখা হবে। এজন্য দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।” সরকারের শেষ দুই বছরে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করে দেখা হবে বলে জানান তিনি।
ইশতেহারের উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতি
# রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে। পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিধান করা হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ এবং উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর প্রকাশ করা হবে।
# বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
# পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল হওয়া গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে শর্ত সাপেক্ষে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
# প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন এক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা হবে।
# প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া হবে।
# র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। র্যাবের বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠন করা হবে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। পুলিশ বাহিনীর ঝুঁকিভাতা বাড়ানো হবে। পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পুলিশের জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্প গৃহীত হবে। ইন্সপেক্টর ও সাব ইন্সপেক্টরদের বেতন ছয় মাসের মধ্যে আপগ্রেড করা হবে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অবসরে গেলেও তাদের রেশনিং সুবিধা দেওয়া হবে।
# সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করা হবে। বর্তমান বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করা হবে।
# ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪সহ সব কালা কানুন বাতিল করা হবে।
# দেশরক্ষা, পুলিশ ও আনসার ব্যতিত শর্তসাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা থাকবে না।
# বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত সকল অনুসন্ধান রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে এসবের অধিকতর তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
# জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশে উন্নীত করা হবে। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডে যোগ্য, সৎ, দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হবে।
# অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ পরিচালনা ও তদারকির ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা হবে।
# দেশে কর্মরত বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিটের আওতায় এনে মুদ্রাপাচার রোধ করা হবে।
# বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন ও অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে।
# একবছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত যেটাই আগে হবে শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। তাদের যৌক্তিক অর্থনৈতিক উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। ২৫ বছর পর্যন্ত তরুণদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ইয়ুথ পার্লামেন্ট গঠন করা হবে।
# সকল মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের নামে দুর্নীতির অবসান ঘটানো হবে। মূল্যস্ফীতির নিরিখে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভাতা বাড়ানো হবে। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সেসব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
# একটি রেন্টাল পাওয়ার প্রজেক্টের উচ্চ ব্যয়ের কারণ তদন্ত করে দেখা হবে।
# দুঃস্থ, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী ও অসহায় বয়স্কদের ভাতার পরিমাণ মূল্যস্ফীতির নিরিখে বৃদ্ধি করা হবে। বেসরকারি ও স্বনিয়োজিত খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য বার্ধক্যের দুর্দশা লাগবের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একটি পেনশন ফান্ড গঠন করা হবে। গরীব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হবে।
# দল-মত, জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল জাতি গোষ্ঠির সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মকর্মের অধিকার এবং জীবন সম্ভ্রম ও সম্পদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এ লক্ষ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
ইশতেহারে বলা হয়েছে, প্রথম তিন বছরে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দুই লাখ মানুষকে চাকরি দেওয়া হবে। আর আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। তরুণ দম্পত্তি ও উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ২০ বছর মেয়াদী ঋণ চালু করা হবে।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment