বীর প্রতীক তারামন বিবির নামে ভিকারুননিসার নাম
সংবাদ বাংলা: দেশ সেরা মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমধিক পরিচিত রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সন্তানকে এই স্কুলে ভর্তি করাতে অভিভাবকদের দৌড়ঝাপের কমতি নেই। শিক্ষার্থী ভর্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ বেশ পুরনো। ১০ লাখ টাকা উৎকোচ দিয়েও কিছু অসাধু অভিভাবক তার মেয়েকে ভিকারুননিসায় ভর্তি করান এমনটা বলেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। রাজধানীজুড়ে অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা ছাড়া নিয়মের তোয়াক্কা করে না ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। এখানে জিম্মি যেমন শিক্ষার্থী-অভিভাবক তেমনি অসহায় নিয়ন্ত্রক শিক্ষা প্রশাসন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার পর ষাট দশক পুরনো রাজধানীর নামি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার নানা অনিয়মের চিত্র নিয়ে মুখ খুলছেন অনেকে। ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তনেরও জোর দাবি উঠেছে। তারা বলছে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পাকিস্তানি দোসর ফিরোজ খান নূনের বিদেশি স্ত্রী ভিকারুননিসা নূনের নামে ঢাকার বেইলি রোডে যাত্রা শুরু করে স্কুলটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে অনেক নামই পরিবর্তন করা হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক তারামন বিবির নামে স্কুলটির নামকরণ করার দাবিতে এখন সরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
১৭ হাজারের বেশি ছাত্রী নিয়ে বেইলি রোড ছাড়াও রাজধানীর আজিমপুর, ধানমণ্ডি ও বসুন্ধরায় ক্যাম্পাস রয়েছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আলাদা ক্যাম্পাস পরিচালনা করার সুযোগ নেই। অবৈধভাবে ক্যাম্পাস চালাচ্ছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
অর্ধযুগ ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো অধ্যক্ষ নেই। ২০১১ সালের পর জুলাইয়ের পর থেকে তিনজন অধ্যক্ষ দায়িত্ব পালন করলেও তাদের সবাই ছিলেন ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে। ওই বছরের ১৩ জুলাই শিক্ষক পরিমল জয়ধর কর্তৃক ‘ধর্ষণের’ পর শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অধ্যক্ষের পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন হোসনে আরা বেগম। তারপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্বে এসে ভারপ্রাপ্ত অবস্থায়েই ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর অবসরে যান মঞ্জু আরা বেগম। এরপর পুনরায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপরই দায়িত্ব ভরসা রাখে গভর্নিং বডি। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবেই ২০১৭ সালের ৩ জুলাই অবসরে যান শিক্ষক সুফিয়া খাতুন। তারপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান নাজনীন ফেরদৌস। অরিত্রীর মৃত্যুর পর আন্দোলনের মুখে বুধবার বরখাস্ত করে স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ। তাকেসহ তিন শিক্ষককে আসামি করে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেছেন অরিত্রীর বাবা, সেই মামলায় এক শিক্ষক গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন।
‘খবরদারি’ করার স্বার্থে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে পূর্ণাঙ্গ অধ্যক্ষ করে না- গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের প্রমাণ পেয়েয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। ভিকারুননিসার গভর্নিং বডির অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের ব্যাপক অর্থ ছড়ানোর বিষয়টি বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে। গভর্নিং বডির সদস্যদের সেচ্ছাচারিতা ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি সামনে আসে। তা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। স্কুল-কলেজের পরিচালনা পর্ষদে স্থানীয় এমপির সভাপতি পদে মনোনীত হওয়ার পথ বন্ধ করে ২০১৬ সালে জুনে রায় আসে সর্বোচ্চ আদালত থেকে। ভিকারুননিসার কয়েকজন অভিভাবকের রিট আবেদনে ওই রায় আসে। এরপর ২০১৭ সালের এপ্রিলে ভিকারুননিসার গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচিত হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম আশরাফ তালুকদার।
বিধিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পর্ষদ অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এরপর তা অনুমোদন দেয় শিক্ষা বোর্ড। অধ্যক্ষ পদাধিকারবলে থাকেন গভর্নিং বডির সদস্য সচিব পদে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শাখা প্রধান (শিফট ইনচার্জ) অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদাচরণ করেন না। গত মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে এসে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বহুদিন ধরে অধ্যক্ষ নেই, একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা বার বার তাগিদ দেয়ার পরও তারা নিয়ম অনুসরণ করে অধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যবস্থা নেয়নি, এটাও একটা বড় ধরনের অনিয়ম।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিতে আসন সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় লটারির বাইরেও শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ উঠে। একটি ভর্তি ১০ লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী। ভিকারুননিসায় অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ঢোকার পরিসংখ্যান পাওয়া যায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের দেয়া তথ্যে। সরকারি নীতিমালার বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রমাণ যেখানে স্পষ্ট। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন নীতিমালা-২০১১ অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত হবে ৩০:১। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী, মাধ্যমিক পর্যায়ে একক শ্রেণি বা শাখায় শিক্ষার্থী সংখ্যা হবে ৫০ জন। তবে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ এর অধিক হলে পরবর্তী ৪০ জনের জন্য দ্বিতীয় শাখা খোলা যাবে। তৃতীয় বা পরবর্তী প্রতি শাখার জন্য পূর্ববর্তী শাখায় ৫০জন পূর্ণ হতে হতে হবে। প্রতি শাখায় একজন করে হিসাব করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। কিন্তু ভিকারুননিসায় চতুর্থ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৭৮ জন আর সপ্তম শ্রেণিতে ৮৩ জন।
শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত ফি’র বাইরে ভর্তির শুরুতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় না করলেও পরে বিভিন্ন নামে সেটা আদায় করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। একজন অভিভাবক জানান, জানুয়ারি মাসে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সময় সরকার নির্ধারিত ৮ হাজার টাকা এবং মাসের বেতন ১ হাজার ১০০ টাকা নেয়া হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি-মার্চের বেতনের ২ হাজার ২০০ টাকা বেতনের সঙ্গে উন্নয়ন ফিসহ বিভিন্ন নামে কমপক্ষে ২ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
ভিকারুননিসা স্কুলে শিক্ষকদের কাছে কোচিং করা অলিখিতভাবে বাধ্যতামূলক। প্রায় সব বিষয়েই ছাত্রীদের কোচিং করতে হয়। বাংলা ও ধর্ম বিষয়গুলো কোচিং করা থেকে বাদ যায় না। অভিভাবকদের বলেন, দুই বিষয় একসঙ্গে করে কোচিং করানো হয় ১ হাজার ২০০ টাকা ফিতে। প্রতি ব্যাচে শিক্ষার্থী নেয়া হয় ৪০জন করে। কোচিংয়ে না গেলে ফেল করানোর অভিযোগ আছে ভিকারুননিসার কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এক সময় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলে ধারাবাহিকভাবে প্রথম হলেও সেই অবস্থান গত কয়েক বছর ধরে রাখতে পারছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৪ সালের এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে তৃতীয় হয়েছিল। ২০১৫ সালে এক ধাপ নিচে নেমে চতুর্থ অবস্থানে। ২০১৪ সালে ঢাকা বোর্ডে এইচএসসিতে পঞ্চম অবস্থানে ছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সেরা ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ভিকারুনিসার কোনো শিক্ষার্থী ছিল না। যেখানে প্রথম হয়েছিল শ্যামপুরের এ কে হাইস্কুলের এক শিক্ষার্থী। এইচএসসিতে সেরা ১০ এর মধ্যে কেবল সপ্তম স্থান ছিল ভিকারুননিসার এক শিক্ষার্থীর।
এ প্রসঙ্গে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচিত হন গোলাম আশরাফ তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অনিয়মের প্রমাণ পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment