বড় রকমের দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে এলাম
মিজানুর রহমান মিথুন: বাড়ি থেকে ঢাকা আসার পথে মাওয়া ফেরি ঘাটে এ দুর্ঘটনার মুখে পড়তে বসেছিলাম। কাঁঠাল বাড়ি থেকে ফেরি ছেড়ে মাওয়া ঘাটে এসে আমাদের ফেরি নোঙর করার সাথে সাথে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরা শত শত মানুষ সেই ফেরিতে হুড়মুড়িয়ে উঠতে লাগলো। মানুষের ফেরিতে ওঠার চাপে আমাদের গাড়িসহ কোনো গাড়িই উপরে উঠতে পারছে না। লঞ্চ পারাপারের বাস সার্ভিস বন্ধ থাকার কারণে মূলত এত বেশি মানুষ এই ফেরিতে উঠে ওপারে যাওয়ার জন্য সবাই ভীষণ তাড়াহুড়া করেছে। ফেরিতে ওঠা এই এসব মানুষ বিভিন্ন পেশার, যারা ঈদের মূল ছুটি এখন কাটাতে বাড়ি যাচ্ছেন।
প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম ফেরির ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষ উঠবে। কিন্তু না ধীরে ধীরে বাড়ি ফেরা মানুষের সংখ্যায় যেন জনস্রোত বইতে শুরু করলো। এদিকে তুমুল বৃষ্টি ঝড়ছে। বাতাস বইছে। অন্যদিকে পদ্মার ঢেউয়ে দুলছে আমাদের ঘাটে নোঙর করা ফেরি। শত চেষ্টা করেও আমাদের বাসসহ অন্যান্য বাস বা প্রাইভেটকার ফেরি থেকে মানুষের চাপে কূলে উঠতে পারছে না। এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা চলতে থাকলো। ঘাটে থাকা দায়িত্বরত পুলিশ বাড়ি ফেরা এসব মানুষদের ফেরিতে উঠতে নিষেধ করলেও কোনো কাজ হচ্ছিল না। কারণ এত বেশি মানুষ ছিলো যে তা এত অল্প সংখ্যক পুলিশ তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলেন না। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে যেতে লাগলো। এ যেন এক নৈরাজ্যকর অবস্থা।
প্রথম দিকে আমি খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। পরে ফেরিতে চাপাচাপি করে উঠতে চাওয়া মানুষের ধাক্কায় শিশু ও নারীদের চিৎকার-আর্তনাত শুনে আমি বিষয়টি গুরুত্বের সাথে খেয়াল করলাম কিছুটা উদ্বিঘ্নও হলাম। ফেরিতে মানুষ উঠছে তো উঠছেই। এরই মধ্যে ফেরিতে এত মানুষ উঠে গেছে যে ফেরির ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করেছে। তারপরও মানুষের ফেরিতে ওঠা থামছে না। ফেরি প্রায় ডুবে যাওয়ার অবস্থা।এই দৃশ্য দেখে আমাদের বাসে থাকা যাত্রীরাও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। মহিলারা কান্নাকাটি শুরু করেছে। বাস থেকে যে কেউ বেড়িয়ে কূলে উঠবে তারও কোনো সুযোগ নেই। মানুষে মানুষে ফেরি কানায় কানায় পূর্ণ।
আমিও বাস থেকে বের হওয়ার চেষ্ট করলাম। কিন্তু পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে এলাম অথচ ‘কূলে এসে ডুবলো তরী’র মত অবস্থা হবে আমাদের। এখানেই ডুবে মরবো! এই অবস্থায় এরমধ্যে এক ঘণ্টা অতিক্রম করেছে। কিন্তু ফেরির দিকে মানুষের ধেয়ে আসা স্রোত যেন আরও বেড়ে চলছে। দৃশ্য দেখে আমার মনে হল পঙ্গপাল যেমন আগুন দেখেও তাতে ঝাপ দেয়, তেমন এই মানুষগুলোও দেখতেছে ফেরি প্রায় ডুবতেছে কিন্তু ফেরিতে ওঠার প্রবণতা থামাচ্ছে না। সবাই যেন জেনে শুনে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। জীবনে আমি এরকম দৃশ্য আর দেখিনি কখনও। আজকের মানুষদের দেখে মনে হয়েছে ফেরিতে উঠার জন্য সবাই উন্মাদ। ভালো-মন্দ, জীবন-মরণ কেউ কিছু বুঝতেছে না। তখন আমার আরও মনে হয়েছে ফেরির দিকে ধেয়ে আসা এই মানুষরা আমার কিংবা ওপার থেকে আসা ফেরিতে থাকা সব মানুষকে খুন করতে ধেয়ে আসছে। শুধু খুনি নয়, এরা আত্মঘাতী, আত্মবিধংসীও। আমাদের ফেরিতে থাকা মানুষদের তো মারবেই, নিজেরাও ডুবে মরবে। মানুষ বাড়ি ফেরার জন্য এমন অধৈর্য্য ও দিশেহারা হয় কিভাবে!!! তা দেখে আমি শুধু বিস্মতি হচ্ছি, বিচলিতও। সাথে সাথে এও ভাবছি এভাবে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দেবো! তা তো হতে পারে না। ফেরির এই ঘটনা আমি আমাদের jagonews24.com-এর করেসপডেন্টে ফেসবুক গ্রুপে জানালাম। ঘটনার ছবিও দিলাম। পাশাপাশি হঠাৎ মনে হলে সরকারের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট পরিচালিত ন্যাশনাল হেপ্ল ডেক্সের ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেই। ফোনও দিলাম। তারা জানালো,- দয়া করে বলুন মাওয়া ফেরি ঘাট কোন জেলার কোন থানার মধ্যে পড়েছে। আমি তা তৎক্ষনাৎ বলতে পারলাম না। পাশের দুয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম তারাও তা বলতে পারলো না। সবাই প্রাণ বাাঁচানো নিয়ে দিশেহারা অবস্থায় আছে। আমি আবার আমাদের জাগো নিউজের করেসপডেন্টে ফেসবুক গ্রুপে জানতে চাইলাম মাওয়া ফেরি ঘাট কোন জেলার কোন থানার মধ্যে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তা আমাকে জানালেন জাগো নিউজের সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মহিউদ্দিন সরকার ভাই। আমি আবার তা পুলিশের ৯৯৯ নাম্বারে জানালাম। সে সময়ে আমাকে ঊর্ধ্বতন এক অফিসারের সঙ্গে ফোনে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বলা হলো। আমি তাকে বললাম,- ফেরির যে অবস্থা এখন, তাতে যদি পর্যাপ্ত পুলিশ পাঠিয়ে যাত্রীদের ফেরি থেকে না নামানো হয় এবং ফেরিতে যাত্রী উঠতে বাধা না দেয়া হয়, তাহলে দেশে আজ আরও একটি জাতীয় বিপর্যয় দেখা দেবে। শত শত মানুষ কূলে ভিড়ানো ফেরিতে বসেই ডুবে মারা যাবে। প্লিজ হেল্প আস। কুইক টেইক অ্যাকশন। কুইক টেইক মেজরস। প্লিজ সেফ আস। আদার ওয়াইস উই আর অল গোগিং টু ডেথ ইমিডিয়েটলি।
আমাকে জানানো হলো,-এখনই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এদিকে কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই দেবদূতের মত পুলিশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যদের উপস্থিতি দেখতে পেলাম। তারা বাঁশি বাজিয়ে মানুষ সরানোর চেষ্টা করছেন। এতে কাজ না হওয়ায় কিছু কিছু পুলিশ সদস্য এসেই এলোপাথাড়ি পেটানো শুরু করলো। তখন মানুষ মুহূর্তের মধ্যে মানুষ সরে যেতে লাগলো। ক্রমেই পুলিশের লাটি চার্চের মাত্রা বাড়ছে। এই দৃশ্য দেখে ফেরি থেকেও মানুষ নামতে শুরু করেছে।
পুলিশের আজকে এই নির্মম বের্তাঘাত দেখে আমি আনন্দিত হলাম। শিহরিত বোধ করলাম। ফেরিতে উঠতে চাওয়া মানুষের গায়ে মারা পুলিশের প্রতিটা বের্তাঘাত যেন আমকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সাহায্য করেছে। আমি প্রত্যাশা করছি পুলিশ যেন আরও সজোরে পোটায়। মানুষের পাছার উপরে মারা বের্তাঘাত দেখে আমার মনে হচ্ছিল প্রতিটা বের্তাঘাত খুবই সুস্বাদু ও আমাদের প্রাণরক্ষাকারী।
কারো শরীরে আঘাত করা দেখে আমি জীবনে এই প্রথম অপার প্রশান্তির এক ব্যতিক্রমী অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।এরপর অনুধাবন করলাম সমালোচিত হলোও জাতীয় জীবনে পুলিশের বের্তাঘাতের যথার্থ গুরুত্ব রয়েছে।
এরপর কয়েক মিনিটের মধ্যে ফেরি এবং ফেরি থেকে বাস কূলে ওঠার রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেলো। আমাদের বাস কূলে উঠলো। আমি কূলে উঠে বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।
ধন্যবাদ পুলিশ সরকারে বিভাগকে। আমি সাধুবাদ জানাই সরকারের এই ৯৯৯ ডিজিটাল সেবা ব্যবস্থাকে।
পুলিশ খুব দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে হয়তো আজ বড় রকমের একটা দুর্ঘনা ঘটে যেতো।আমিও সবার সাথে প্রাণহারা হতভাগ্য মানুষ হতাম।
আরও ধন্যবাদ পুলিশ বিভাগ তথা বাংলাদেশের এই ডিজিলাইজেশনের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে। সেই সাথে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আমার প্রিয় সম্পাদক অভিবাক শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দীন সরকার ভাইকে। যিনি দ্রুততম সময়ে আামকে মাওয়া ঘাটের অবস্থারে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন।
এবার সবার উদ্দেশ্যে বলছি,- আপনারা এ রকমের যে কোনো সমস্যা কিংবা বিপদের মুখোমুখি হলে সঙ্গে পুলিশের ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিন। নিজে নিরাপদ থাকুন অন্যকে নিরাপদ রাখুন। সবার জন্য সতত শুভ কামনা। (ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment