মোহাম্মদ মোরসি মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের উত্থান ও পতন
সংবাদ বাংলা: হোসনি মোবারককে উৎখাতের পর নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট হন মোরসি
মোহাম্মদ মোরসি ছিলেন মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। সামরিক বাহিনী তাকে উৎখাতের আগে মাত্র এক বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ‘আরব বসন্ত’ নামে খ্যাত সরকার বিরোধী বিক্ষোভের পর ২০১২ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তার মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুডের এই নেতা মোহাম্মদ মোরসি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ৩রা জুলাই তাকে মিসরের সেনাবাহিনী উৎখাত করে। কয়েকদিনের সেই সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল মিসরের অবস্থাকে বলা হয় ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর সবচেয়ে খারাপ রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আরব বসন্তের মুখেই পদত্যাগ করেছিলেন হোসনি মোবারক। ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনী মোরসিকে সংকট সমাধানে আল্টিমেটাম দিলে, মোরসি তা মানতে অস্বীকার করেন। এরপর সামরিক বাহিনী এক অভ্যুথ্থানের মাধ্যমে তাকে উৎখাত করে। বিবিসি অবলম্বনে
উৎখাতের চার মাস পরে, মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনের আরো ১৪জন ঊর্ধ্বতন নেতার সঙ্গে মোহাম্মদ মোরসির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একজন সাংবাদিক ও দুইজন সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীকে হত্যায় প্ররোচনা দেবার অভিযোগ আনা হয় মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। বিরোধী বিক্ষোভকারীদের বেআইনিভাবে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয় মোরসির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে কায়রোর ইত্তিহাদিয়া প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদের বাইরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ঐ গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। শুনানির প্রথম দিনে মোরসি কাঠগড়া থেকে চিৎকার করে বলেছিলেন, তিনি সেনা অভ্যুত্থানের শিকার এবং তার বিচার করার বৈধতা এ আদালতের নেই। পরে হত্যার অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়, কিন্তু বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার ও দমনের অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরবর্তীতে মোরসির বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ আনা হয়, এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যদিও পরে সে রায় বাতিল করা হয়েছিল।
২০১৯ সালের ১৭ই জুন মৃত্যুর সময় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তার বিচার চলছিল। মোহাম্মদ মোরসি ১৯৫১ সালে মিশরের শারকিয়া প্রদেশের আল-আদওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ এর দশকে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন, এরপর পিএইচডি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। মিশরে ফিরে এসে তিনি জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান হন। এক সময় মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনে যোগ দেন তিনি এবং ক্রমে নেতৃত্বে আসেন। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত এই আন্দোলনের হয়ে দেশটির সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন।
সংসদ সদস্য হিসেবে ভালো বক্তা বলে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন অনেকবার, বিশেষ করে ২০০২ সালে এক রেল দুর্ঘটনার পর কর্মকর্তাদের নিন্দা করে তার দেয়া বক্তব্য খুবই আলোচিত হয়েছিল। ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের ডেপুটি জেনারেল গাইড, মিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী খাইরাত আল-সাতেরকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। এরপর মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে মোরসিকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
নির্বাচনী প্রচারণায় মোরসি নিজেকে হোসনি মোবারকের সমর্থকদের পুনরুথ্থানের বিরুদ্ধে একমাত্র কার্যকর বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেন। নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে জিতে ২০১২ সালের জুনে মিশরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন মোহাম্মদ মোরসি। সব মিশরীয় মানুষের রাষ্ট্রপ্রধান হবার প্রতিশ্রুতি দিলেও সমালোচকদের অভিযোগ, পরবর্তীতে সে প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করতে পারেননি। অভিযোগ রয়েছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থীদের একচ্ছত্র আধিপত্যের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ মোরসি এবং মনে হচ্ছিলো যেন মুসলিম ব্রাদারহুডই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।
সেই সঙ্গে দেশটির অর্থনীতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবং বেকারত্ব ছিল প্রকট। এসব অভিযোগে কিছুদিনের মধ্যেই অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে শুরু হয় ব্যাপক গণবিক্ষোভ। এই সময়ে নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করা হচ্ছিল, এবং নিজের ক্ষমতা সুদূরপ্রসারী করার চেষ্টায় মোরসি একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। বিক্ষোভ চলার মধ্যেই, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে নতুন সংবিধানের উপর একটি গণভোটের আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও নির্বাচনী এলাকা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতা দিয়ে মোরসি আরেকটি ডিক্রি জারি করেন। সমালোচকেরা মনে করেন ওই ডিক্রি কার্যত দেশটিতে এক ধরণের সামরিক আইন জারি করার পরিস্থিতি তৈরি করে।
এরপরই তার সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়, যাতে ৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। মোরসির ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশটিতে যেদিন আনন্দ মিছিলের কর্মসূচী দেয়, সেই দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ গণবিক্ষোভে যোগ দেয়।
মোরসিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জনগণের দাবি মানার সময় বেঁধে দিয়েছিল সেনাবাহিনী। ৩রা জুলাই সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী সংবিধান স্থগিত করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়। পরবর্তী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ঐ সরকার দায়িত্ব পালন করবে বলে বলা হয়। সেনাবাহিনীর এ পদক্ষেপকে ‘অভ্যুত্থান’ বলে নিন্দা জানান মোরসি।
সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং নতুন প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি মোরসিকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। তাকে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক সপ্তাহ তার কোন খোঁজ ছিল না। এরপর মোরসির মুক্তি এবং তাকে অবিলম্বে ক্ষমতায় পুনরায় অধিষ্ঠিত করার দাবিতে কায়রোর রাস্তায় নেমে আসেন তার দলের সমর্থকেরা। জবাবে দুটি বিক্ষোভ শিবির ভেঙ্গে দেয় এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। সন্ত্রাস দমনের নামে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভিযানে মিশরে প্রায় এক হাজার মানুষ মারা যায় সেসময়।
মোরসির উৎখাতের পর দেশটিতে ইসলামপন্থীদের হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পায়, এবং মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের ওপর চালানো হয় ব্যাপক নিপীড়ন, এবং ফল হিসেবে হাজার হাজার ব্রাদারহুড কর্মী গ্রেফতার বা নিহত হন। অনেকে কাতার এবং তুরস্কে পালিয়ে যান। এরপর মোরসি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান, মাঝেমধ্যে মামলার হাজিরা দিতে তাকে আদালতে আনা হলেই কেবল তাকে দেখা যেত।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment