রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে সংকটে পড়বে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া
সংবাদ বাংলা: সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে গুরুতর মানবিক বিপর্যয়ে পড়বে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। এমন সতর্কতা দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষেশজ্ঞরা বলেছেন, ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো ও আসন্ন ঝুঁকি এড়াতে জাতিসংঘসহ বিশ্বকে খুব দ্রুত কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে একশনএইড বাংলাদেশ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট: টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে’ বিষয়ক দু’দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা।
অনুষ্ঠানে আয়োজকদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে একটি বিশ্লেষণপত্র উপস্থাপন করা হয়। যেখানে বলা হয়, রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বিষয়। এখন পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৭ সালে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রস্থানের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে, যা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট হিসেবে পরিগণিত। রোহিঙ্গাদের প্রতি নিপীড়নের বাস্তবতা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমান। আবার নিরাপদ প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গাদের অধিকার। তবে তা এখনো দৃশ্যমান না। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা সংকটের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাঁচটি ঝুঁকি নিয়ে একটি বিশ্লেষণপত্র তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, “মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিগত যে বিদ্বেষ ও মিয়ানমারের অবস্থান এই সমস্যা সমাধানে বড় প্রতিবন্ধকতা। চীন ও ভারতের মত দেশ এই সমস্যা সমাধানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর জাতিসংঘ যদি আন্তর্জাতিক আইন ও বড় রাষ্ট্রগুলোর সম্মতি নিয়ে এগিয়ে না আসে তবে সমস্যা সমাধান কঠিন হবে।” তিনি আরো বলেন, “রোহিঙ্গা বিষয়টি এখন আর মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সংকট নয়, এই বিষয়ে আমাদের পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে। এটা এখন জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংকট। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হবে। মানবিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা প্রকট হবে। সর্বহারা রোহিঙ্গাদের উপর যে গণহত্যা ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে তার বিচার হওয়াটাও জরুরী।”
এরপর দেশ ও দেশের বাইরের বিশেষজ্ঞরা রোহিঙ্গা সংকটের ঝুঁকি ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচকরা বলেন, এই সংকট নিরসনে বিলম্ব হলে বৈশ্বিক নজর রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে সরে যেতে পারে। অতএব, মানবিক, রাজনৈতিক, জেন্ডার এবং নিরাপত্তা বিষয়সহ বৈশ্বিক নীতিমালা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক যে আইনগত দিক রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করে সমাধানে আসাটা খুবই জরুরী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মিয়ানমারের জন্য কানাডা সরকারের বিশেষ দূত রবার্ট কেইথ-এর একটি লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার বেনয়েট প্রিফন্টেইন। তিনি বলেন, “মিয়ানমার সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বুঝতে হবে যে রোহিঙ্গারাও মানুষ। সহিংসতার কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নি:স্ব হয়ে গেছে। তাই তাদের সহায়তায় এবং অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের সকলকে জাগ্রত হতেই হবে। কানাডা সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে খুবই উদ্বিগ্ন এবং এই পরিস্থিতি কোনভাবেই সমর্থন করে না। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতেই হবে। তবে এক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিপি-র কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জী বলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ একটি জটিল মূহুর্তে আছে। তাই খুব দ্রুত সম্মানের সাথে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তাদের মিয়ানমারে শুধু পাঠিয়ে দিলেই হবে না, তারা মানুষ হিসেবে সেখানে সম্মান পাচ্ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে।” তিনি আরো বলেন, “রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধানে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিদের।”
অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টর ফর পিস এন্ড জাস্টিস-এর নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পূর্বে আমাদের এই সংকট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় এগিয়ে না আসে তাহলে তারা অচিরেই অনিরাপদ এবং বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। সামাজিকভাবে ভয়াবহ সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। দ্রুত গভীর এই সংকট নিরসন এবং টেকসই সমাধানের জন্য একসঙ্গে কাজ করার কোন বিকল্প নেই।”
অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতিও পর্যালোচনা করা হয়। বাংলাদেশে আসা এসব রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। স্বদেশহীন এই জনগোষ্ঠী বিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন জাতি। যাদের প্রতি মূহুর্তে ন্যূনতম মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, বারবার শিকার হয়েছে সহিংসতার। ফলস্বরূপ, প্রথমে ’৭০-এর দশকে, পরে ’৯০-এর দশকে এবং সবশেষ গত তিন বছরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে প্রাণ বাঁচাতে অনুপ্রবেশ করে রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের কক্সবাজারে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করতো। কিন্তু ২৫ আগস্ট থেকে এই সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সবচেয়ে দ্রুত বর্ধিত শরণার্থীর আশ্রয়স্থল হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমার ও জাতিগত সমস্যার ফসল। এখন এটি শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ইস্যু না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত এই সংকটের টেকসই সমাধান করতে চাই আমরা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি হলো, তাদের কাউকে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে না; কোন ধরনের সহিংসতা চালানো হবে না এবং কারো সাথে কোন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হবে না।” তিনি আরো বলেন, “রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আগে মিয়ানমার সরকারকেও প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, রাখাইন রাজ্যে আর কখনো সহিংসতা চালানো হবে না। অনতিবিলম্বে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এবং শর্তহীনভাবে আনান কমিশনের প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন করা হবে। আর এক্ষেত্রে মিয়ানমারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ”
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্মানের সাথে তাদের অধিকার ভোগ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা পুরোটাই ভিন্ন। এই ইস্যু এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বিষয়। শিগগিরই রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের উদ্যোগ না নিলে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে। চাপ পড়বে দেশীয় অর্থনীতির উপর। এছাড়া রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং দ্বি-পাক্ষিক বা তৃ-পাক্ষিক কূটনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে এই সংকট।”
রোহিঙ্গা সংকটে একটি দূরদর্শী ও টেকসই সমাধানের জন্য আমরা ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট: টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে” এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এর উদ্দেশ্য, পরবর্তী সময়ে সহিংসতা প্রতিরোধ, শান্তিপূর্ণ অবস্থার পুনর্বহাল এবং রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের উপায় বের করা। কৌশলগত আলোচনার মাধ্যমে মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, জেন্ডার, সুরক্ষা, অধিকার এবং নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দুই দিনের এই সম্মেলনে। তুলে ধরা হচ্ছে মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধে এবং আইনগত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সুপারিশ এবং দিক-নির্দেশনাসমূহও। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক সহায়তা, সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ঝুঁকি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক মাত্রা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশর প্রতিনিধিরা এসব বিষয়ে বিশ্লেষণপত্র ও গবেষণা তুলে ধরছেন সম্মেলনে।
এই সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহুমাত্রিক কন্ঠস্বর একত্রীকরণ এবং সুপারিশসমূহ কার্যকরের লক্ষ্যে ‘ঢাকা ঘোষনা’ উপস্থাপন করা হবে। সেখানে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। এছাড়া দেশ ও বিশ্বের বিভন্ন দেশে কাজ করা কূটনৈতিক এবং গবেষকরাও উপস্থিত থাকবেন।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment