শিল্প-সাহিত্যের আঁতুড়ঘর বিউটি বোর্ডিং (ভিডিও)
পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে ঢুকেই শ্রীশ দাস লেনে মোড় নিলেই চোখে পড়বে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বিউটি বোর্ডিং। এই বিউটি বোর্ডিং বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার একটি কেন্দ্র বা ইতিহাসের ভিত্তিভূমি। এখানে এসে দাঁড়ালে একটি জ্যান্ত ইতিহাসের খোঁজ মেলে। যেন মুখে বোল ফোটে জড় দেওয়ালগুলোর। বলতে চায় তার হারানো অতীতের জয়গাথা। এক সময়ের জৌলুস অহংয়ের সেসব কথা। হয়তো কান পেতে কেউ শুনতে চাইলে ঠিক শুনতে পাবে তার কথা। সারাক্ষণ আড্ডা আর ঝলমলে তারকাদের ভিড়ে মুখর থাকত এর প্রাঙ্গণ।
সারা দেশ খুঁজলে এমন বহু আড্ডার জায়গা পাওয়া যাবে; কিন্তু বিউটি বোর্ডিংয়ের বিশেষত্ব ছিল আলাদা। এখানে যারা আড্ডা দিতেন তারা ছিলেন সৃষ্টিশীল। এখানে বসেই তৈরি হতো রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রস্তুতি কিংবা মননশীলতার চর্চা। এখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বসেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনের সভা করেছেন, দিয়েছেন বিভিন্ন দিকনির্দেশনা। তবে এখনকার জমজমাট আড্ডার প্রাণপুরুষ ছিলেন কবি শহীদ কাদরী ও বেলাল চৌধুরী। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় এই বিউটি বোর্ডিং হয়ে ওঠে দেশের শিল্প-সাহিত্যের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এখানে বসে সকাল-সন্ধ্যা আড্ডা দিতেন। এখানে বসেই জন্ম দিয়েছেন তাদের বিখ্যাত সব লেখার। এ ছাড়াও এখানকার আড্ডা মাতাতেন খালেদ চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সঞ্জীব দত্ত, ফজলে লোহানী, ফতেহ লোহানী। আসতেন বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। আসতেন হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া ব্রোজেন দাশ। খোয়াবনামার স্রষ্টা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমদ ছফা, হায়াৎ মামুদ, অমর সুরকার সত্য সাহা, সাদেক খান, এনায়েত উল্লাহ খান, কবি আল মাহমুদ, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কবি নির্মলেন্দু গুণ ও জাদুসম্রাট জুয়েল আইচসহ অনেকে। এই তুমুল আড্ডায় ছেদ
পড়ে ১৯৭১ সালে। ২৫ মার্চ ঢাকায় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানি শোষকরা খবর পায়, বিউটি বোর্ডিং বাংলাদেশের মেধাবীদের সর্ববৃহৎ আড্ডা।
অতঃপর হামলা। ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিং ঘিরে ফেলা হয় এবং মালিক প্রহ্লাদ সাহা ও বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার-বোর্ডারসহ প্রায় ১৭ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
বিউটি বোর্ডিংয়ে ২৪টি কক্ষ। এর মধ্যে সিঙ্গেল কক্ষ আটটি। তিনবেলাই খাবারের ব্যবস্থা আছে। সকালের আগে এই রেস্টুরেন্টকে কেন্দ্র করেই আড্ডা চলত। তৈরি হতো অনেক মুখরোচক খাবার। আর সেই খাবার ছিল অনেকের প্রিয় খাবারের তালিকায়। এখানে পাওয়া যায় দেশি রুই মাছের বড় পেটি, খল্লা মাছ, বাটা মাছ, পুঁটি, চাপিলা, বোয়াল, পাবদা, আর শরষে ইলিশ, সঙ্গে দেশি মুরগির কারি। সবজি হয় নানা রকমের। বেগুন ভাজি, করলা ভাজি, কচুশাক, লালশাক, কলাভর্তা, শিম ও মৌ-শিমভর্তা আর ধনেপাতার ভর্তা প্রতিদিনের মেন্যু। সকালে এক সময় আটার রুটির রেওয়াজ ছিল। এখন সকালে ভাত, আলুভর্তা, ডিম ভাজি আর ডাল করা হয়। রাতে রান্না সীমিত। এক পদ মাছ, সবজি আর ডাল। তবে দই এখানে তিনবেলাই পাওয়া যায়। এখানকার মূল আকর্ষণ হচ্ছে শরষে ইলিশ। সারা বছরই এখানে শরষে ইলিশ পাওয়া যায়। অনেকে শখ করে দূর থেকে আসে কালের ইতিহাসের সাক্ষী এই বিউটি বোর্ডিংয়ে।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment