‘স্যার, এভাবে শেষ করে দেবেন না’
সংবাদ বাংলা: তিন সন্তানের জননী (৩০) নিজের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য আকুতি-মিনতি করেও হৃদয় গলাতে পারেনি ওসির। স্যার আমার ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। আমাকে এভাবে শেষ করে দেবেন না। এ সময় ওসি অট্টহাসি দিয়ে আমাকে বিবস্ত্র করে ফেলে তার রুমের মধ্যে ধর্ষণ করে। সে চলে যাওয়ার পরে থানার গৌতম দারোগাসহ চারজন পুলিশ রাতভর আমার ওপর নির্যাতন চালায়। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে সেই রাতে খুলনা রেলওয়ে (জিআরপি) থানার ওসি ওসমান গনি পাঠানসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের ধর্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন এবং মূর্ছা যান। এ সময় একটু দূরে ধর্ষণের শিকার ওই নারীর সাত ও আড়াই বছরের দুটি কন্যাসন্তান নিয়ে তার বৃদ্ধা মা দাঁড়িয়েছিল।
এর আগে, ৪ আগস্ট রোববার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট খুলনার আদালতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জিআরপি থানার ওসির রুমে রেখে রাতভর ধর্ষণের ঘটনাও বর্ণনা দেন ওই নারী। আদালতের নির্দেশে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য রোববার রাতে ওই নারীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে পরীক্ষা হয়নি। সোমবার তাকে আবারও হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বিকালে তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়।
এদিকে, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ওসি ওসমান গনিসহ সংশ্লিষ্টরা মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সমঝোতায় রাজি না হওয়ায় সে হুমকি দিচ্ছে বলেও ওই গৃহবধূর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন।
এদিকে এ ঘটনাটির তদন্তের জন্য কুষ্টিয়া রেলওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ফিরোজ আহমেদকে সভাপতি ও ডিআইও-১-এর পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) স ম কামাল হোসেন এবং দর্শনা রেলওয়ের ইমিগ্রেশন ক্যাম্পের ওসি মো. বাহারুল ইসলামকে সদস্য করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের আগামী ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, ২ আগস্ট ঘটনার রাতে খুলনা রেলওয়ে জিআরপি থানার ওসি ওসমান গনি পাঠান, এসআই গৌতম কুমার পাল, এসআই নাজমুল হাসান, কনস্টেবল মিজান, হারুন, মফিজ, আবদুল কুদ্দুস, আলাউদ্দিন, কাজলসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিল। তবে, ওই নারী ওসি ওসমান গনিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তাকে ধর্ষণ ও মারধরের অভিযোগ করেছেন।
ধর্ষিতা গৃহবধূর খালাতো ভাই শাহাবুদ্দিন মাতব্বর জানান, শুক্রবার তার বোন (৩০) যশোর থেকে ট্রেনে খুলনায় আসেন। এদিন রাত সাড়ে ৭টার দিকে খুলনা রেলস্টেশনে কর্তব্যরত জিআরপি পুলিশের সদস্যরা তাকে সন্দেহ করে ধরে নিয়ে যায়। পরে গভীর রাতে জিআরপি পুলিশের ওসি ওসমান গনি পাঠান তাকে ধর্ষণ করে। এরপর আরও চার পুলিশ কর্মকর্তা (সদস্য) তাকে ধর্ষণ করে। পরদিন শনিবার ওই নারীকে ৫ বোতল ফেনসিডিলসহ মাদক মামলা দিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালতে বিচারকের সামনে নেওয়ার পর ওই নারী জিআরপি থানায় তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা তুলে ধরেন। এরপর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট খুলনার আদালতে ওই তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন।
গৃহবধূর ভাই মো. সেলিম হাওলাদার জানান, আমাকে পুলিশ বলে, তোমার বোনকে মোবাইল চুরির জন্য ধরে নিয়ে এসেছি। আমি বলেছি, স্যার আমার বোনতো এসব করে না। পুলিশ বলে, এই তুমি বেশি জান? এই একে ধর। বোনের সঙ্গে ভাইরেও লকআপে ভর। আমি বলি, স্যার কী বলছেন? সে বলে, এই বেশি কথা বলবি না। যা বাসা থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে আয়। আমি বলি, আমরা গরিব মানুষ টাকা পাব কই? সে বলে, টাকা পাবি কই, আমি জানি না। তুই টাকা নিয়ে আয়। তা না হলে ওরে ছাড়ব না।
এরপর রাত ১০টা পর্যন্ত আমি ওইখানে বসে থাকি। আমাকে অনেক ভয়-ভীতি দেখাইছে। ‘ফেনসি দিমু নয় বাবা দিয়া চালান দিয়া দিমু।’ যাও বাসায় যাও, ভালো লোক হয়ে থাকলে বাসায় যাও। আমি ভয়ে চলে এসেছি। চলে আসার পর ভোর ৬টায় গেছি। যাওয়ার পরে বলে, এদিকে এসো, টাকা আনছ? আমি বলি, স্যার আমরা গরিব মানুষ, আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। ঠিক আছে এখন ৭ বছর জেল খাটলে… এরপর আমাকে বলে এই ভোটার আইডি কার্ড ফটোকপি করে আন। আমি আনছি, আনার পরে এবার আমার ছোট বোনকে বের করেছে। আমাকে ফটোকপি আনতে দিয়ে ফেনসিডিল দিয়ে ওরে বের করছে। আমি বলি স্যার এই আনছি। এরপর আমার বোন আমারে জড়িয়ে ধরে বলে, ভাইয়া আমারে পাঁচটি ফেনসিডিল দিয়েছে ব্যাগে। আমি বলি আমাকে ফটোকপি আনতে দিলেন, এখন পাঁচটি ফেনসিডিল দিয়ে চালান দিলেন। এরপর পুলিশ বলে, ‘এই বেডা বেশি কথা কবি না। আমি তখন একা ছিলাম। ভয়ে আমি আর তখন কিছু বলিনি।’
ভুক্তভোগীর বড় বোন জানান, তার বোনের শ্বশুর বাড়ি সিলেটে ও বাবার বাড়ি খুলনার ফুলবাড়ীগেট এলাকায়। তাদের মা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তাকে দেখতে খুলনায় এসেছে বোন। বোন নিজে অসুস্থ থাকায় বৃহস্পতিবার যশোরে ডাক্তার দেখাতে যান। পরদিন শুক্রবার খুলনায় আসার সময় ফুলতলা এলাকায় জিআরপি পুলিশ প্রথমে তাকে মোবাইল চুরির অপরাধে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে রাতে জিআরপি পুলিশের ওসি ওসমান গনি তার বোনকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ করেন। এরপর আরও চারজন পুলিশ সদস্য তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে বলেও অভিযোগ করেন। পরে শনিবার পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ তাকে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ।
তিনি আরও জানান, আদালতে বিচারকের সামনে নেওয়ার পর তার বোন জিআরপি থানায় তাকে গণধর্ষণের বিষয়টি তুলে ধরেন। এরপর আদালতের বিচারক জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তার ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশ দেন।
তবে অভিযুক্ত ওসি ওসমান গনি এ ঘটনা মিথ্যা বলে দাবি করেছে। সে বলে, শুনেছি ওই নারী তাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে আদালতে অভিযোগ করেছে। কিন্তু তাকে পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক করা হয়।
There are no comments at the moment, do you want to add one?
Write a comment